‘বৃহত্তর জোটে’ হেফাজতের সমর্থন চায় বিএনপি, থাকছে জামায়াত

হাসান শান্তনু

সরকারের বিরুদ্ধে ‘একদফা দাবিতে আন্দোলনে’ যাওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। ‘কার্যকর আন্দোলন’ গড়ে তোলার আগে সরকারবিরোধি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোকে নিয়ে নতুন জোট গঠনের পরিকল্পনা করেছেন দলটি শীর্ষনেতারা। দলের নেতৃত্বের ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের অর্ন্তভুক্ত দলগুলোকে নতুন জোটে রাখার লক্ষ্যে আলোচনা চলছে। একইসঙ্গে সরকারবিরোধি অবস্থানে থাকা ডান ও বাম দলগুলোকে জোটে রাখার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। নতুন জোটে বিতর্কিত ও পুরনো মিত্র জামায়াত থাকছে, ধর্মপন্থি সংগঠন হেফাজতের সমর্থনও আগের মতো চাচ্ছেন বিএনপির নেতারা।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্র মত ও পথকে জানায়, সংসদের ভেতরে ও বাইরে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে বহুল আলোচিত বিলের সমালোচনায় মুখর ছিল বিএনপি। ইসি আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়ার দিনও খসড়া না ‘না দেখে, না পড়ে’ এ বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন দলটির শীর্ষনেতারা। নানা প্রক্রিয়া শেষে সংসদে বিল পাস হওয়ার পর আন্দোলন কর্মসূচি পালন করবে কী না, এ বিষয়ে দলটি নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। আপাতত শুধু দলীয় অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে সদ্য প্রণীত আইনটির সমালোচনার সিদ্ধান্ত হয়েছে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠকে। দলের নেতৃত্বের ‘বড় আকারের জোট’ গঠন করে আন্দোলনে নেমে ‘একদফা দাবি আদায়ের’ কথা ভাবছে বিএনপি।

universel cardiac hospital

সূত্র বলছে, সংসদে ইসি গঠনের আইন পাসের দিন ২৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার তাৎক্ষণিভাবে তা ‘প্রত্যাখ্যান’ করে বিএনপি। পরদিন শুক্রবার রাতে দলের সর্বোচ্চ ফোরাম স্থায়ী কমিটির দীর্ঘ বৈঠক হয় গভীর রাত পর্যন্ত। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে ভার্চ্যুয়ালি রাত নয়টা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ওই সভা চলে বলে স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান। বৈঠকে ‘বৃহত্তর জোট গঠনের’ সিদ্ধান্ত হয়। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বিরোধি রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ‘বড় জোট’ গঠনের ওপর গুরুত্ব দেন নেতারা। ‘বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার’ প্রধান অন্তরায় জামায়াতকে ছাড়বে না দলটি। দলটিকে আগের অবস্থানে রেখেই আন্দোলনের ছক সাজানোর পরিকল্পনা হয়। জোটের প্রতি হেফাজতের সমর্থনের জন্য নতুন করে সংগঠনটির সঙ্গে আলোচনার জন্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্যকে বৈঠকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বিএনপির শীর্ষনেতারা মনে করেন, ২০১৩ সালে আলোচনায় আসা কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক উগ্রপন্থি ও বিতর্কিত সংগঠন হেফাজতের সঙ্গে বিএনপির তলে তলে ও প্রকাশ্যে যোগাযোগ সবসময়ই ছিল। এরপরও সংগঠনটির কয়েক নেতার ‘সখ্য ও ঘনিষ্ঠতা’ ছিল সরকারের সঙ্গে। কিন্তু গত বছরের ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে সফর কেন্দ্র করে ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত সহিংসতার বিরুদ্ধে একপর্যায়ে সরকার ‘কিছুটা কঠোর অবস্থান’ নেয়। বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। গ্রেপ্তার হন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। সারাদেশে টানা গ্রেপ্তার অভিযানসহ নানামুখি চাপে পড়ে হেফাজত। সংগঠনটির নতুন নেতৃত্ব ‘সরকারবিরোধি অবস্থানে’ আছে। এ পরিস্থিতিতে সংগঠনটির সমর্থন বিএনপির দিকেই থাকবে।

যোগাযোগ করলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মত ও পথকে রোববার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে বলেন, ‘অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচন চায় না বিএনপি। বিনা ভোটের এ সরকার অবৈধভাবে টিকে থাকার জন্য বাকশালের মতো বিতর্কিত ইসি আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইন আমরা মানি না। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাব।’

জানতে চাইলে হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক মওলানা মীর ইদ্রিস মত ও পথকে বলেন, ‘হেফাজত ১৩ দফা দাবি সামনে রেখে গঠিত হয়েছে। দাবিগুলোর উপর আমরা অটল রয়েছি। ভবিষ্যতেও এসব ইস্যুতে আমরা কাজ করব। হেফাজত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। বিএনপির নতুন জোটে হেফাজতের সমর্থনের জন্য দলটির পক্ষে এখনো কেউ আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করেননি আমাদের সঙ্গে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক ‘বিশ্বাসে বিরোধ’ থাকলেও ‘অরাজনৈতিক’ দাবিদার হেফাজতের কর্মসূচিতে শুরু থেকে সমর্থন দেওয়াকে ‘রাজনীতির অংশ’ বলে আসছে বিএনপি ও জামায়াত। ‘জাতীয় স্বার্থ, মুসলমানদের ইমান-আকিদার প্রশ্নে’ যেসব কর্মসূচি দেয় হেফাজত, তাতে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেয় দল দুটি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সবশেষ ঢাকা সফরের বিরুদ্ধে হেফাজতের বিক্ষোভ ও হরতালে সহিংসতায় ১৭ জনের মৃত্যু হয় বলে সংসদে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এ সহিংসতায় বিএনপি ও জামায়াতের হাত আছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা।

মত ও পথের কাছে থাকা তথ্যমতে, গত বছরের তাণ্ডব ও সহিংসতার জের ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় হেফাজতের বিরুদ্ধে ১৬৫টি মামলা হয়। এসব মামলায় আসামি করা হয় সংগঠনটির চার হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হন দুই হাজারের বেশি। তাদের মধ্যে জামিন নিয়েছেন অন্তত এক হাজার ৩০০ আসামি। এ মুহূর্তে কারাগারে আছেন প্রায় ৭০০ জন। বাকি দুই হাজার আসামি জামিন নেননি।

শেয়ার করুন