ভূমধ্যসাগর : মানব পাচারের মৃত্যুফাঁদ

মো. জিল্লুর রহমান

ফাইল ছবি

ইউরোপে মানবপাচারের সবচেয়ে বড় রুট এখন ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ লিবিয়া। যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশটি ইউরোপে মানবপাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য হিসাবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অন্যদিকে এ রুটটিই মানবপাচারকারীদের মৃত্যুফাঁদ হিসাবে সারা বিশ্বে ব্যাপক পরিচিত হয়ে উঠেছে।

কিছুদিন পরপরই এ রুটে নৌকাডুবে মৃত্যুর খবর দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয়। কিন্তু তারপরও থামছে না এ বিপজ্জনক মৃত্যুর মিছিল ও মানবপাচারের জঘন্য খেলা। অনেকেই মরিয়া হয়ে ইউরোপ যাওয়ার সোনালি স্বপ্ন দেখছে আর এ সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে একদল সুযোগসন্ধানী মানবপাচারকারী। ২৫ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে ঠান্ডায় জমে সাতজন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন।

এরা নৌকাযোগে লিবিয়া থেকে ইতালির ল্যাম্পাডুসা দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। ওই নৌকায় ২৮০ জন অভিবাসন প্রত্যাশী ছিলেন, যাদের অধিকাংশই বাংলাদেশ, মিসর, মালি ও সুদানের নাগরিক। তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্টের এক তথ্যমতে, এর আগে ২০২১ সালের জুলাই মাসে ভূমধ্যসাগরে ৮৪ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও ৪৩ জন ডুবে মারা যায়। উদ্ধার হওয়া ৮৪ জনের মধ্যে বাংলাদেশসহ আরও চারটি দেশের নাগরিক ছিল। এ ঘটনায় আহত হন আরও কমপক্ষে ১১ জন। তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। এ ছাড়া ২০২০ সালের মে মাসে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানবপাচারকারীদের গুলিতে ২৬ জন বাংলাদেশি ও চারজন আফ্রিকান নাগরিকের মৃত্যু ঘটে। এ ধরনের খবর প্রতিনিয়ত আসছে।

মানবপাচারকারী চক্র বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে যুবকদের লিবিয়ায় নিয়ে থাকে। এরপর তাদের পণবন্দি করে পরিবারের কাছ থেকে সাত-আট লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করার পর ইতালি বা ইউরোপের কোনো দেশে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে নৌকা বা ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব অভিবাসীর সলিল সমাধি হয় সাগরে। আবার অনেকের জীবন যায় মানবপাচারকারীদের নির্যাতন-নির্মমতায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, দেশজুড়ে থাকা পাচারকারী চক্রের সদস্যরা ইউরোপে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে লোক সংগ্রহ করে।

তারপর সেসব লোককে সড়ক-বিমানপথ মিলিয়ে তিনটি রুটে লিবিয়ায় পাঠায়। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে নৌপথে তিউনিসিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে পাঠায়। সাত থেকে আট লাখ টাকার বিনিময়ে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগে দুই মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত। ভিকটিমদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকিট ক্রয় সবই এ সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। ইউরোপে পাচারে চক্রটি তিনটি রুট ব্যবহার করে থাকে। এক্ষেত্রে তারা সড়ক ও বিমানপথ ব্যবহার করে লিবিয়া পৌঁছে দেয়। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে নৌপথে তিউনিসিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে মানবপাচার করে থাকে চক্রটি।

ইউরোপ পাচারকারীদের প্রথম ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ লিবিয়া। লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মূলত দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলছে। এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু এ সুযোগ নিয়ে প্রায় এক দশক ধরে মানবপাচারকারী চক্র সেখানে সক্রিয়। লিবিয়ায় দালালরা তাদের একটি ঘরে বন্দি রাখে। এরপর শুরু হয় লোমহর্ষক ভয়ংকর সব ঘটনা। ইউরোপগামীদের ওপর দালাল চক্র চালায় নির্মম নির্যাতন। দফায় দফায় টাকা নেওয়ার পর সাগরপথে ইতালির উদ্দেশে পাঠানো হয়। সেখানেও দালাল চক্রের আরেকটি অংশের হাতে আটক থাকতে হয়। যারা তীরে ভিড়তে পারেন, তাদের কাছ থেকে আবারও টাকা আদায়ের জন্য নির্যাতন চলে। কয়েক দফা টাকা দেওয়ার পর ভাগ্য সহায় হলে অবৈধভাবে কাজের সুযোগ পান অনেকে। আবার কেউ কেউ জেলহাজতে স্থান পান। অনেকে ইতালির উপকূলে পৌঁছাতে পারেন; আবার অনেক সাগরে ডুবে চিরতরে হারিয়ে যান।

২০১৯ সালের ৯ মে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরের নৌকাডুবিতে প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ জন নিখোঁজ হন। এদের মধ্যে বাংলাদেশি ছিলেন ৩৯ জন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভিকটিমের স্বজনরা তখন শরীয়তপুরের নড়িয়া ও সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় দুটি মামলা করেন। এ মামলার সূত্র ধরেই তখন তদন্তে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ওই বছরের ১৬ মে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুটি পাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে আটক করে। তখন ইউরোপে মানবপাচারের সঙ্গে দেশজুড়ে অন্তত ১০ থেকে ১৫টি চক্রের তথ্য পাওয়া যায়।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সাম্প্রতিক এক তথ্যমতে, গত ১২ বছরে ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে ৬২,৫৮৩ জন বাংলাদেশি। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ৩,৩৩২ জন বাংলাদেশি নয়টি ভিন্ন ভিন্ন রুটে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। তাদের বেশিরভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এ ছাড়া ১৭,৬৩৯ জন বাংলাদেশি পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় রুট (সমুদ্র ও স্থলপথ উভয়ই) এবং আরও ৮৫৭ জন পশ্চিমা ভূমধ্যসাগরীয় রুট (সমুদ্র ও স্থলপথ উভয়ই) ব্যবহার করে ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে ইউরোপে প্রবেশ করেন।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় কর্মী পাঠানো গত পাঁচ বছর ধরে বন্ধ। তারপরও কী করে এত লোক বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া যাচ্ছে, সেই ঘটনার তদন্ত করা উচিত। গত কয়েক বছরে আইওএম ও ব্র্যাকের প্রত্যাশা প্রকল্প থেকে সাড়ে তিনশ লিবিয়াফেরত বাংলাদেশিকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ফিরে আসা বাংলাদেশিরা পণবন্দি ও মুক্তিপণ আদায়সহ নিপীড়নের নানা লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন ও গণমাধ্যমেও এসব কথা উঠে এসেছে। এভাবে যেন আর কোনো অভিবাসী সেখানে প্রাণ না হারায়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।

মানবপাচারকারীরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। বল্গাহীন ঘোড়ার মতো বেপরোয়া মানবপাচারকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা খুবই জরুরি; অন্যথায় এরা মানুষের জীবন নিয়ে বিপজ্জনক খেলা খেলতেই থাকবে।

মো. জিল্লুর রহমান : ব্যাংকার ও লেখক

শেয়ার করুন