যৌনকর্মীর সন্তানদের বাবার পরিচয়হীনতার মতো সামাজিক সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একইসঙ্গে নপুংসক বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, অনাথ আশ্রম ও এতিমখানায় যারা বেড়ে উঠেছেন, তাদের মা-বাবার পরিচয় জটিলতাসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কারো পরিচয়ের সম্মানজনক সমাধানের কথাও আছে ইসির নতুন উদ্যোগে।
বর্তমান ইসির মেয়াদ আছে আর মাত্র হাতেগোণা কয়েকদিন। এতো অল্প সময়ের মধ্যে বিষয়টি পরিকল্পনা অনুযায়ী গুছানো, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ও বিধিবিধান বাস্তবায়নে প্রস্তাব পাঠানো তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের প্রশ্ন, উদ্যোগটি প্রশংসনীয় হলেও মেয়াদের শেষদিকে এসে কেন ও কী উদ্দেশ্যে নেওয়া হলো?
ইসির সূত্র মত ও পথকে জানায়, বাবা-মায়ের পরিচয় সংকটে থাকা সন্তানদের জন্য সম্মানজনক পরিচয় নির্ধারণে সমাধানের পথ বের করতে সংস্থাটি উদ্যোগ নেয়। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও সুপারিশ নেওয়ার জন্য গত মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় কর্মশালার আয়োজন করে ইসি। এতে পাওয়া বিশেষজ্ঞদের মত ও সুপারিশ নিয়ে নিয়মানুযায়ী প্রথমে বৈঠক করতে হবে ইসির আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটিকে। চলতি সপ্তাহে ইসিতে বৈঠকটি হওয়ার কথা রয়েছে।
ওই বৈঠকে নির্ধারিত সুপারিশগুলো পাঠাতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে। এরপর এ বিষয়ে আইন করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠাবে ইসি। এতো কিছু করার সময় সাংবিধানিক এ সংস্থার হাতে এখন নেই। বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। এ সময়ের মধ্যে নতুন আইন প্রণয়নের প্রস্তাবনা সাজানো, আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ও মন্ত্রণালয়ের পক্ষে নতুন আইন প্রণয়ন সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান ইসি নিয়ে রাজনৈতিক নানা বিতর্ক আছে। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগও আছে। মেয়াদ শেষ হলেও এ রকম একটি আইনের প্রস্তাব পাঠিয়ে ‘বাহবা’ পেতে চান তাঁরা। দায়িত্বে না থাকলেও বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা হলে তাঁদের প্রসঙ্গ আসতে পারে ইতিবাচকভাবে। কারণ, উদ্যোগটি শুরু করেছিলেন তাঁরা। গত পাঁচ বছরের মধ্যে না করে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে উদ্যোগ নেওয়ায় বিষয়টিতে ইসির আন্তরিকতার ঘাটতি বোঝা যায়। তবে উদ্যােগটি প্রশংসার দাবি রাখে।
কারণ, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, যৌনালয়ে বেড়ে ওঠা শ্রেণি, চা-শ্রমিকসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকে বাবা-মায়ের পরিচয় উল্লেখ না করায় ইসির ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত হতে পারছেন না। ফলে তারা সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিধবা ভাতার মতো সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বলয় কার্যক্রমও ইসির ডেটাবেজভিত্তিক। বাবা-মায়ের পরিচয় সংকট থাকলে এসব কার্যক্রমের সুবিধা পাওয়া যায় না। তাই পরিচয় সংকটের সমাধানে আইন প্রণয়ন, বা ভিন্ন একটা পদ্ধতি নির্ধারণ অবশ্যই দরকার।
যোগাযোগ করলে ইসির আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটির প্রধান ও নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা হয়তো ফাইল ওয়ার্ক করে যাবো। পরবর্তী কমিশন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবে। আলোচনা করে হয়তো সরকারের যে সংস্থার কাছে পাঠানো দরকার, সেখানে পাঠাবেন তাঁরা।’
- আরও পড়ুন >> নতুন মাত্রা পাচ্ছে বাংলাদেশ-লুক্সেমবার্গ সম্পর্ক
মত ও পথকে তিনি বলেন, ‘সমাজে পরিচয় সংকটের বিষয়টি শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটার তালিকার জন্য সমস্যা নয়। জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকা ইসি করে। তাই ইসি এ বিষয়ে আইন করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাতে পারে।’
তিনি মনে করেন, ‘যাদের বাবা-মায়ের পরিচয়ে সংকট থাকে, তাদেরকে সমাজে নানাভাবে নিগৃহীত হতে হয়। তাদের পিতা-মাতার পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য কিছু কী হবে, এ বিষয়ে সম্মানজনক একটা সমাধান প্রয়োজন। না হলে সমাজের মূলধারায় তাদেরকে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে। সংবিধানে উল্লেখিত সুযোগ সুবিধাগুলো তাদেরকে নিশ্চিত করতে হলেও বাবা-মায়ের পরিচয় সংকটের সমাধানের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা উচিত।’
প্রসঙ্গত, গত ৬ জানুয়ারি ঢাকার হোটেল সোনারগাঁওয়ে ‘ভোটার তালিকায় পরিচয়হীনদের বাবা ও মায়ের নাম লিপিবদ্ধকরণে জটিলতা নিরসন’ শিরোনামে কর্মশালার আয়োজন করে ইসি। এতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকতা, বিভিন্ন সংস্থার প্রধান, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ইসির শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেন। তারা গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন।