ঘুরে দাঁড়াতে চায় হেফাজত, সরকারের ‘নরম সুর’, সমর্থন চায় বিএনপি

হাসান শান্তনু

হেফাজত
ফাইল ছবি

‘প্রশাসনের ভেতর ঘাপটি মেরে আছেন নাস্তিক্যবাদীর প্রতিনিধিরা’- প্রশাসন সম্পর্কে এমন উস্কানিমূলক মন্তব্যের ছয়দিন পর হেফাজতে ইসলামের নেতারা বৈঠক করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। সংগঠনটির দাবি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করলে প্রতিবারই ‘সুফল’ পায় তারা। আর এ ‘সুফল’ কাজে লাগিয়ে তারা আবারো ঘুরে দাঁড়াতে চায়। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে মাঠে নামতে চান উগ্রপন্থি এ সংগঠনের নেতারা। আগামী নির্বাচনে বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটের মাঠে সমর্থন দেওয়া-না দেওয়ার প্রশ্নে আগেভাগেই দরকষাকষি করতে চান বরাবরই ‘অরাজনৈতিক’ দাবিদার এ সংগঠনের নেতারা।

সরকারের একটা অংশও তাদের প্রতি গত বছরের মার্চে ভয়াল তাণ্ডবের জন্য আগের মতো ‘কঠোর’ নয়। সরকারবিরোধি ‘বৃহত্তর জোট গঠনের’ পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত নেওয়া বিএনপিও নতুন জোটে হেফাজতের সমর্থন চাচ্ছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দরকষাকষির সামনের সময়টাকে যথাযথ কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হেফাজত নেতারা। এর জন্য সাংগঠনিকভাবে ‘আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়া’ ও নিজেদের ‘শক্তিশালী অবস্থান’ জানান দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। সংগঠনটির শীর্ষনেতাদের সঙ্গে আলাপ করে ও গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য পেয়েছে মত ও পথ।

বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে ‘অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও অস্বাভাবিক কোনো সময়কে’ শুরু থেকেই কাজে লাগিয়ে আসছে হেফাজত। গত বেশ কয়েকমাস সংগঠনটির শীর্ষনেতারা গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে ও নিরব থাকার পর চলতি মাসে হঠাৎ করে প্রকাশ্যে আসেন তারা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে চলমান বিধিনিষেধের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম যখন সীমিত, তখন তারা প্রথমে সংবাদমাধ্যমে গত ৩ ফেব্রুয়ারি একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ‘কারাবন্দী নেতাকর্মীসহ আলেমদের মুক্তির’ দাবি জানান। এর ছয়দিন পর গতকাল ৯ ফেব্রুয়ারি, বুধবার বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে একই দাবি জানান সংগঠনটির নেতারা।

একাধিক গোয়েন্দা সূত্র মত ও পথকে জানায়, হেফাজতের সঙ্গে ‘টানাপোড়েন’ কমাতে চায় সরকারের একটা অংশ। সরকারের ওই অংশের সংগঠনটির প্রতি ‘নতুন সমর্থনের ইশারায়’ তারা চলতি মাস থেকে আবার প্রকাশ্যে আসতে চাচ্ছেন। কারাবন্দী নেতাদের ‘মুক্তির’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে বুধবারের ওই বৈঠক হয়। নেতাদের মুক্তির বিষয়ে সরকারের তরফে বেশকিছু শর্তারোপ করা হয়। হেফাজত নেতারাও সেগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন।

তাছাড়া গত ২৮ জানুয়ারি গভীর রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিএনপির সর্বোচ্চ ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, দলটির নেতৃত্বে সরকারবিরোধি ‘বৃহত্তর জোট গঠনের’। নতুন জোটের প্রতি হেফাজতের সমর্থনের জন্য সংগঠনটির সঙ্গে আলোচনা, যোগাযোগ চালিয়ে যেতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্যকে বৈঠকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আরো তোড়জোড় শুরু করে হেফাজত। সংগঠনটির শীর্ষ কয়েক নেতার বিএনপির সঙ্গে ‘সতর্কতাসহ গোপন যোগাযোগ’ চলছে।

হেফাজত বলছে, সংগঠনের আমির শাহ আহমদ শফী, মহাসচিব ও পরে আমির জুনায়েদ বাবুনগরী, মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী, মহাসচিব নুর হোসাইন কাসেমী মারা গেছেন অল্প সময়ের ব্যবধানে। দুজন আমির ও দুজন মহাসচিব হারিয়ে ‘নেতৃত্ব সংকট’ সৃষ্টি হয়েছে। সেটাও কাটিয়ে উঠতে চায় তারা। সেজন্য আগে দরকার কারাবন্দী নেতাকর্মীদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার। তাদের বিরুদ্ধে ২০১৩, ২০১৬ ও ২০২১ সালে দায়ের করা মামলা আছে। সব মামলা ‘প্রত্যাহার করার জন্য’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সবশেষ বৈঠকে দাবি জানায় সংগঠনটি।

গত ৩ ফেব্রুয়ারির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হেফাজতের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী দাবি করেন, ‘প্রশাসনের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা নাস্তিক্যবাদীর প্রতিনিধিরা সরকার ও হেফাজতের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি এবং দূরত্ব সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। হেফাজতে ইসলাম বিশৃঙ্খলা চায় না।’ এতে প্রশাসনকে নিয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্যের পাশাপাশি দেশজুড়ে নিজেদের তাণ্ডবলীলার কথা অস্বীকার করে বিতর্কিত সংগঠনটি। গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে সফরের বিরোধিতা করে ওই তাণ্ডব চালায় হেফাজত। ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সংগঠনটির বৈঠক নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের তাণ্ডব
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের তাণ্ডব। ফাইল ছবি

গত বছর দেশজুড়ে হেফাজত নেতাদের নাশকতার সময় পুলিশ প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল, তারা বড় ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ‘রাষ্ট্রক্ষমতা দখল’। ‘রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চক্রান্তকারীরা’ গত বছরের ৫ জুলাই করোনা রোধে অবরুদ্ধ (লকডাউন) অবস্থা চলাকালে সরকারি বিধিনিষেধ অমান্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে ‘নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি’ জানাতে বৈঠক করেন। ওই বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও হেফাজতের তখনকার আমির জুনায়েদ বাবুনগরী সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি৷ একই বছরের ১৯ এপ্রিল ও ৪ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন হেফাজত নেতারা৷

সবশেষ বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজতের মহাসচিব সাজিদুর রহমান বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর মত ও পথকে মুঠোফোনে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের বক্তব্য খুব ভালো করে, মনোযোগসহকারে শুনেছেন। আমরা তাঁকে ৪৮২ জন কারাবন্দী নেতাকর্মীর তালিকা দিয়েছি। তিনি আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন- তাদের মুক্তির ব্যাপারে সহযোগিতা করার।’

বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত হতে যাওয়া নতুন জোটকে সমর্থনের বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস মত ও পথকে বলেন, ‘হেফাজত ১৩ দফা দাবি সামনে রেখে গঠিত হয়েছে। দাবিগুলোর উপর আমরা অটল রয়েছি। ভবিষ্যতেও এসব ইস্যুতে আমরা কাজ করব। হেফাজত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। বিএনপির নতুন জোটে হেফাজতের সমর্থনের জন্য দলটির পক্ষে এখনো কেউ আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করেননি আমাদের সঙ্গে।’

জানা যায়, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন গত বছরের মার্চে। সে সময় তাঁর সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজত। ২৬ মার্চ ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভ কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়।

এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঠে নামে হেফাজত। সংগঠনের নেতাকর্মীরা সেদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। সংঘর্ষে ১৯ জন নিহত ও পুলিশসহ ৫০০ জন আহত হন। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। ওই সহিংসতার ঘটনায় সারাদেশে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১৫৪টি মামলা করা হয়। ঘটনার পর এক হাজার ৩০৩ জন গ্রেপ্তার হন। পরে অনেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন।

শেয়ার করুন