উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মতো তৃণমূলের নির্বাচন দলীয় প্রতীকের বদলে ভিন্নভাবে আয়োজনের ব্যবস্থা হলে ভালো হয় বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের কয়েক নেতা। গঠন হতে যাওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে এ বিষয়ে চিন্তাভাবনার কথা দলের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর বিষয়টিও দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আলোচনা করতে চান তারা। সাতধাপে সদ্য শেষ হওয়া ইউপি নির্বাচনসহ এর আগের ইউপিসহ তৃণমূলের নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে তারা নতুন চিন্তা করছেন বলে মত ও পথকে জানিয়েছেন।
সরকারি দলের পর্যবেক্ষণ বলছে, সদ্য শেষ হওয়া ইউপি নির্বাচনের বিভিন্ন দিক ছাপিয়ে বারবার আলোচনায় আসছে সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনাগুলো। এবারের নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের তৃনমূলের নেতাকর্মী ও দলের মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত, সংঘর্ষ হয়। এতে দলের বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দলের জনপ্রিয়তা আরো বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সংসদ নির্বাচনের আগে ইউপি নির্বাচন কেন্দ্র করে জন্ম নেওয়া সমালোচনা দূর করতে দলের এখন বাড়তি উদ্যোগ নিতে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের দুজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মত ও পথকে বলেন, সিটি কর্পোরেশন বা যে কোনো নির্বাচনের তুলনায় ইউপি নির্বাচনে প্রাণহানির ঘটনা বেশি ঘটে। সংঘাতও হয়। নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের জরিপ বলছে, দেশে গত কয়েক দশক ধরে ইউপি নির্বাচনে প্রাণহানির ঘটনা বেশি। বিষয়গুলোর সঙ্গে স্থানীয় কোন্দল, সামাজিক সংঘাত ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বও জড়িত থাকে। এসব ঘটনার সঙ্গে প্রায়ই কেন্দ্রীয় পর্যায়ের রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা তেমন থাকে না। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় সমালোচনা বেশি হয় রাজনৈতিক দলগুলোকে ঘিরে। এটা দলের জন্য বাড়তি চাপ।
ওই দুইনেতা আরো বলেন, তৃণমূলের বিভিন্ন নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে ইউপির নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করা নিয়ে ভাবছি আমরা। দলের সভাপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর তনয়া ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা অনানুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে সম্প্রতি আলোচনা করেছেন। দলে অসন্তোষ, বিভেদ ও সংঘাত এড়াতে ইউপি নির্বাচন চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে না করার বিষয়ে আগেও দলীয় সভায় আলোচনা হয়েছে। তবে এখনো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন থেকে সরে আসার বিষয়টি পাকা সিদ্ধান্তের পর্যায়ে যায়নি। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সামনের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে তারা মত ও পথের কাছে উল্লেখ করেন।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের কয়েক নেতা মত ও পথকে বলেন, বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে কখনো কখনো দলের জন্য অপেক্ষাকৃত কম নিবেদিত ও দুর্বল প্রার্থী কেন্দ্র থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে আসেন। তখন এলাকার সক্রিয় নেতাকর্মীরা তার পক্ষে কাজ না করে অপেক্ষাকৃত দলের জন্য বেশি নিবেদিত ও জনপ্রিয় প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেন। আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা পাওয়া প্রার্থী বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে বিদ্রোহী প্রার্থীকে দমিয়ে রেখে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার চেষ্টা করেন। এ কারণেও স্থানীয়ভাবে দলের নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণের চেষ্টা করেন। এলাকায় সংঘাত-সহিংসতা সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, সদ্য শেষ হওয়া ইউপি নির্বাচন ঘিরে এমন রক্তক্ষয়ী সহিংসতার প্রধান কারণ হচ্ছে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠান। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের কারণেই তৃণমূল পর্যায়ে সহিংসতা আগের চেয়ে দিনে দিনে বাড়ছে। তাই দলীয় প্রতীক ছাড়াই স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার দাবি তাদের।
অন্য বিশেষজ্ঞরা দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়াকে ‘সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত’ বলে মনে করেন। তাদের মতে, দলীয় প্রতীকে যেসব স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচিত হন, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় থাকে, যা নির্বাচনী এলাকার মানুষের জন্য বেশি পরিমাণে উন্নয়নমূলক কাজ করতে সহায়তা করে। গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারে নির্বাচিতরা এলাকায় উন্নয়নমূলক অনেক কাজ করেছেন।
২০১৫ সালের নভেম্বরে উপজেলার চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের আইন পাস হয়। এর আগে মন্ত্রিসভা এই তিন স্তরের সব নির্বাচনই দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।