জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঘাতক ও জাতীয় চারনেতাকে হত্যাকারী চক্রকে বিএনপির সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও রাষ্ট্র্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়গুলো নতুন প্রজন্মের অনেকের তেমন জানা নেই। দলটির বিতর্কিত এসব ভূমিকা তাদের কাছে চাপা পড়ে আছে। মেজর (অব.) মোহাম্মদ খায়রুজ্জামান মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার হলে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া ঠেকাতে বিএনপির শীর্ষ একনেত্রীর তৎপরতা, পলাতক খায়রুজ্জামানের সঙ্গে দলের শীর্ষনেতাদের যোগাযোগ থাকার অভিযোগ কেন্দ্র করে চারনেতার ঘাতকদেরকে রক্ষায় বিএনপির অতীত ভূমিকার কথা আলোচনায় আসছে। এসব প্রশ্নে দলটি আবার ‘বেকায়দায়’ পড়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে মত ও পথকে এ প্রসঙ্গে রোববার দুপুরে বলেন, ‘সরকারবিরোধি বৃহত্তর জোট গঠনের কার্যক্রম চালাচ্ছে দল। এমন সময়ে জেলহত্যায় সন্দেহভাজন খায়রুজ্জামান মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার হলে বিএনপির সরকারের আমলে তার কূটনীতিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। জেলহত্যায় জড়িতদেরকে রক্ষায় বিএনপির আগের তৎপরতার কথা দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমে নতুন করে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এতে তরুণ প্রজন্মের কাছে দলকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে দলটি। যে কোনো দলের জন্য তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় থাকা ও তাদের সমর্থন, ভোট অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।’
বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের চারজন নেতা বলেন, জেলহত্যা মামলার আসামি (পরে বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলে খালাস) খায়রুজ্জামানকে দেশে ফেরত পাঠাতে ‘সাময়িক নিষেধাজ্ঞা’ দিয়েছে মালয়েশিয়ার একটি আদালত। তার স্ত্রী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেত্রী রিটা রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ নিষেধাজ্ঞা দেয়। যা প্রগতিশীল চিন্তার প্রজন্মের কাছে বিএনপির বিষয়ে নেতিবাচক বার্তা দেবে। ওই প্রজন্মকে বিএনপির প্রতি সমর্থন বিমুখ করে তুলতে পারে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে জামায়াতের নেতাদের বিচার শুরু হলেও কৌশলে বিচারের বিপক্ষে বিএনপি অবস্থান নেওয়ায় নতুন প্রজন্মের কাছে দলটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দেশে-বিদেশে দলটি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এসব কারণে দলের সরকারবিরোধি কর্মসূচিতেও তাদের সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে না।
গোয়েন্দা সূত্র মত ও পথকে জানায়, গ্রেপ্তারের পরই খায়রুজ্জামানকে সরকারের দেশে ফেরানো ঠেকাতে তৎপর হয়েছেন তার স্ত্রী ও বিএনপির শীর্ষ নেত্রী রিটা রহমান। খায়রুজ্জামানের এক যুগের বেশি সময় ধরে মালয়েশিয়ায় পালিয়ে থাকার তথ্যটি জানতেন দলটির কয়েক জ্যেষ্ঠ নেতা। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকো সপরিবারে মালয়েশিয়ায় থাকাকালে তাদের সঙ্গে খায়রুজ্জামানের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। ২০০৯ সাল থেকে তিনি পলাতক। ওই বছর আওয়ামী লীগের সরকার তাকে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরতে নির্দেশ দেয়।
রিটা রহমান দেশে ও মালয়েশিয়ায় মিলিয়ে থাকেন। তার বাবা মশিউর রহমান যাদু মিয়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধি ছিলেন। দালাল আইনে গ্রেপ্তারও হন। তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সরকারের মন্ত্রী হন৷ রিটা বিএনপির জোটসঙ্গী ‘ন্যাশনাল পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশের’ প্রধান ছিলেন৷ একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি নিজের দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দেন৷ তিনি ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৩ আসনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন৷ খায়রুজ্জামানকে গ্রেপ্তার, তার সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ কয়েক নেতার গোপন যোগাযোগের অভিযোগ প্রসঙ্গে দলটির কেউ নাম প্রকাশ করে মত ও পথের কাছে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানা যায়, একসময় জেলহত্যা মামলার আসামি ও মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত সাবেক হাইকমিশনার মেজর (অব.) খায়রুজ্জামানকে দেশে সহসাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব না-ও হতে পারে। বিতর্কিত সাবেক এ কূটনীতিক জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) স্বীকৃত শরণার্থী হওয়ায় তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন ধাপ পার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। জাতিসংঘের স্বীকৃত শরণার্থীরা যতো বড় অপরাধীই হোক, আশ্রিত দেশের আদালতে তারা সংস্থাটির পক্ষে বেশ কিছু আইনি সহায়তা পেয়ে থাকেন। তবে তাকে দেশে ফেরত আনা যাবে না, এমনটি বলার সুযোগ নেই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, খায়রুজ্জামানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে নানা কূটনৈতিক চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। সেজন্য মালয়েশিয়ার সঙ্গে বন্দিবিনিময় ও দেশটির সঙ্গে পারস্পরিক আইনি সহায়তা চুক্তি করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা চলছে। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর মালয়েশিয়ার সরকারের কেউ কেউ দেশটির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অভিবাসন সংক্রান্ত আইন লংঘনের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷’ বিষয়টির দিকেও খেয়াল রাখছে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কারণ, তিনি মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইন লঙ্ঘন করে থাকলে সাধারণ প্রবাসীরা অপরাধ করলে যে পদ্ধতিতে তাদেরকে দেশে পাঠানো হয়, তাকেও একই পদ্ধতিতে দেশে ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা খায়রুজ্জামান গ্রেপ্তার হওয়ার একদিন পর মালয়েশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি নিশ্চিত করে। দেশটির ইমিগ্রেশন পুলিশ গত ৯ ফেব্রুয়ারি তাকে সেলাঙ্গর প্রদেশের আমপাং এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জয়নুদ্দিন গত ১০ ফেব্রুয়ারি বলেন, ‘বাংলাদেশের অনুরোধে দেশটির খায়রুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য তাকে বিধি মেনেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে আটকের জন্য বাংলাদেশ সরকার অনুরোধ জানিয়েছিল।’ মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হামজা জয়নুদ্দিন এসব তথ্য জানান বলে নিশ্চিত করে দেশটির ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ‘দ্য স্টার’।