‘অনুসন্ধান কমিটির’ (সার্চ কমিটি) কাছে আসা প্রস্তাবিত নামের তালিকা প্রকাশের পর থেকে চলছে নতুন তর্ক-বিতর্ক। বিশিষ্টজনদের মধ্যে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন ‘তালিকা প্রকাশের ধরন’ নিয়ে। তাদের মতে, নাম প্রকাশের এ পদ্ধতি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ নয়। নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের এমন ‘প্রক্রিয়া বিশ্বে বিরল’। প্রস্তাবিত নামের সঙ্গে প্রস্তাবকারী রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তির নাম, পরিচয় প্রকাশ না করলে বিষয়টিতে ‘স্বচ্ছতার ঘাটতি’ থাকে।
বিভিন্ন সুবিধা পাওয়ার আশায় ব্যক্তিদের নাম সব রাজনৈতিক দল প্রস্তাব করে থাকলে শক্তিশালী ও যোগ্য ইসি গঠন করা যাবে না। অনেকে বলছেন, কে কোন নাম প্রস্তাব করেছেন, সেটা বলা বাঞ্ছনীয় নয়। কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রস্তাবের বিষয়টি প্রকাশ হলে সেই ব্যক্তি দলনিরপেক্ষ হলেও তার নামের সঙ্গে ‘দলীয় ছাপ’ যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাদের নাম একটা ‘মার্কা’ হয়ে যেতে পারে।
তখন ওই দল, সংগঠনের সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃক্ত থাকার অনর্থক তর্ক উঠতে পারে ব্যক্তির বিরুদ্ধে। বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে অনেকে নিজের নাম এভাবে অনুসন্ধান কমিটির তালিকায় দেখতে আগ্রহী হবেন না। ২০১২, ২০১৭ সালে গঠিত আগের সার্চ কমিটিগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি সত্ত্বেও প্রস্তাবিত নাম প্রকাশ করেনি। এবারের কমিটি তা করেছে। যা প্রশংসনীয়।
সূত্র জানায়, সার্চ কমিটির এক বৈঠকে প্রস্তাবিত নামের পাশাপাশি প্রস্তাবকের নাম প্রকাশের পরামর্শ দেন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিকের’ (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। কমিটির সভাপতি প্রস্তাবে আসা নামগুলো প্রকাশ করার কথা বলার পর তিনি প্রস্তাবকের নাম প্রকাশের কথা বলেন। তখন উপস্থিত চার-পাঁচজন বিশিষ্ট নাগরিক এর বিরোধিতা করেন। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে রাজনৈতিক দলের নাম প্রকাশের বিষয়টি আর এগোয়নি।
প্রস্তাবিত নামগুলো প্রকাশের বিষয়টি প্রশংসনীয় হলেও কারা কার নাম প্রস্তাব করেছে, তা প্রকাশের পক্ষে নন ইতিহাসবিদ, গবেষক অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো কার কার নাম প্রস্তাব করেছে, সেটা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে আমরা অনুসন্ধান কমিটির বৈঠকে পরামর্শ দিয়েছি। কে কোন নাম প্রস্তাব করেছে, সেটা বলা বাঞ্ছনীয় নয়। তাহলে একটা মার্কা হয়ে যাবে।’
যোগাযোগ করলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন মত ও পথকে বলেন, ‘যে পদ্ধতিতে সার্চ কমিটির নাম প্রকাশিত হয়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ তালিকায় এমন অনেক ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাদের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। যা খুবই অযৌক্তিক। ইসি গঠনের এমন প্রক্রিয়া বিশ্বে বিরল।’
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে প্রস্তাবিত নামগুলো জনগণকে জানানোর জন্য সার্চ কমিটি তালিকা প্রকাশ করে। কে কার নাম প্রস্তাব করেছে, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে দলগুলো নাম প্রস্তাব করেছে, তাদের নাম বলে দিলে ইসির সম্ভাব্য কর্মকর্তাদের গায়ে ট্যাগ পড়ে যাবে। অনুসন্ধান কমিটি প্রকাশিত তালিকার বাইরেও যে-কাউকে চূড়ান্ত করতে পারে।
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম, প্রস্তাবিত নামের সঙ্গে প্রস্তাবক রাজনৈতিক দলগুলোর নাম প্রকাশ করতে। এখন নামগুলো যেভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। যাদের কাছ থেকে সুবিধা পেতে পারে, এমন ব্যক্তিদের নাম সব রাজনৈতিক দল দিলে যোগ্য ইসি গঠন করা যাবে না। নাম প্রকাশের পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। একেবারেই কিছু না হওয়ার চাইতে এটি মন্দের ভালো।’
তিনি বলেন, ‘দেখা গেল, বাম ঘরানার কোনো রাজনৈতিক দল তার আদর্শে বিশ্বাসী বা অনুগতদেরই নাম প্রস্তাব করেছে, তাহলে উপসংহার হতো, বামপন্থি দলটি সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না। তারা এমন ইসি চায়, যা তাদের পক্ষ হয়ে কাজ করবে।’
বদিউল আলম মজুমদার মত ও পথকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দল ও তাদের প্রস্তাবিত নাম কোনো গোপন বিষয় নয়। তথ্যের সঙ্গে সত্যের যোগসূত্রতা রয়েছে। কোন ব্যক্তি, দল ও সংগঠন কার নাম প্রস্তাব করেছে, সে তথ্য ব্যক্তি, দল ও সংগঠনের নামসহ একটি ছকে প্রকাশ করলে বিষয়টি বেশি বিশ্বাসযোগ্য হতো।’
প্রসঙ্গত, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে গঠিত সার্চ কমিটি গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের কাছ থেকে নাম চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। কমিটির কাছে আসা প্রস্তাবিত নামের তালিকা প্রকাশিত হয় গতকাল সোমবার রাতে।