কা. মোল্লার দলীয় তথ্য ‘অস্বীকার’ জামায়াতের, জাফরুল্লাহর বিকৃত তথ্যে ‘সমর্থন’

হাসান শান্তনু

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও আবদুল কাদের মোল্লা । ফাইল ছবি
রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধুর ঘাতক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসি কার্যকরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসে বাংলাদেশ সাহসী।

ফাঁসি হওয়া জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ১৯৭১ সালে ‘ছাত্র ইউনিয়ন করা’র দাবি এবং প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মিথ্যাচারের প্রতি ‘সমর্থন’ জানিয়েছে জামায়াত। তাঁর দাবিকে ‘সত্য বক্তব্য’ বলে দাবি করলেও দলটির ওয়েবসাইটে কাদের মোল্লা সম্পর্কে ঝুলছে ভিন্ন তথ্য। যা ডা. জাফরুল্লাহর নতুন দাবি ও এর প্রতি জামায়াতের ‘সমর্থনকে’ মিথ্যাচার ও ফের ইতিহাস বিকৃতি বলে প্রমাণ করছে।

কা. মোল্লাকে নিয়ে ইতিহাস বিকৃত করায় সমালোচনার কবলে পড়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ। তার ‘বক্তব্য’ সমর্থন করে জামায়াত নিজেদের মনগড়া তথ্যও বিকৃত করেছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধন হারানো দলটির বিরুদ্ধে একনেতার সম্পর্কে দুইরকম মিথ্যাচার করার অভিযোগ উঠেছে। বাঙালির শ্রেষ্ঠতম গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি চলতে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। ‘হলোকাস্ট অস্বীকৃতি আইন’সহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধে কার্যকর আইন না থাকা, আইন থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় বিকৃতি চলছে বলে অভিমত তাদের।

universel cardiac hospital

ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক ও বর্তমান কয়েক নেতা মনে করেন, প্রমাণিত এক যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নকে ‘জুড়ে দেওয়া’ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে সংগঠনটির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ও পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে হওয়া আন্দোলনে ইউনিয়নের ভূমিকা নিয়ে ‘জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে’ এটা জাফরুল্লাহ ও জামায়াতের মিলিত ‘ষড়যন্ত্র’ হতে পারে। মিথ্যাচারের অভিযোগে জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সংক্ষুব্ধ এক ছাত্রনেতা।

একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নেতা, বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিলে তখন থেকেই হলোকাস্ট অস্বীকৃতি আইনসহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধে কিছু আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছি আমরা। ইউরোপের হলোকাস্ট অস্বীকৃতি আইনের মতো আইন প্রণয়নের দাবি বহুবার আমরা জানিয়েছি। ইতিহাস বিকৃতি প্রতিহত করতে গণহত্যার শিকার ইউরোপের ১৪টি দেশ ওই আইন প্রণয়ন করে।’

তিনি বলেন, ‘ওই আইনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যার পরিসংখ্যান অস্বীকার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এমন আইন না করলে ভবিষ্যতে একাত্তরের পরাজিত শক্তি ক্ষমতায় এলে দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার লেশমাত্র থাকবে না। যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি বা একাত্তরে শহীদদের অবমাননাও বন্ধ হবে না।’

গতকাল ১৮ ফেব্রুয়ারি সংবাদমাধ্যমে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাছুমের পাঠানো এক বিবৃতিতে ডা. জাফরুল্লাহর বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানায় দলটি। মাছুমের দাবি, ‘জাফরুল্লাহ প্রকৃত সত্যের একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রকাশ করেছেন মাত্র।’ একাত্তরের প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার পক্ষে ইতিহাস বিকৃত করায় ডা. জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন মামলা দায়ের করে। বিবৃতিতে এর ‘নিন্দা’ জানায় জামায়াত।

তথ্যমতে, গত ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সভায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ দাবি করেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ভুল করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কাদের মোল্লাকে কসাই কাদের সাজিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। কাদের মোল্লা ১৯৭১ সালে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন।’

জামায়াতের দলীয় ওয়েববসাইটে ‘স্মরণীয় যারা’ বিভাগে লেখা রয়েছে, ‘কাদের মোল্লা তৎকালীন সমাজের অন্যান্য মানুষের মতো সমাজতন্ত্রের চটকদার রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তিনি মওলানা মওদুদির লেখা তাফসির তাফহিমুল কোরআন পড়ে কোরআনের হৃদয়স্পর্শী বাণীতে মুগ্ধ হন। ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে ছাত্রসংঘে যোগদান করেন।’

ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ‘তিনি (কাদের মোল্লা) পরবর্তীতে ছাত্রসংঘের শহিদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি, ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি এবং কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।’ মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই তিনি ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে দলটির ‘গুরুত্বপূর্ণ নেতা’ হয়ে উঠেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ বছর আগে কাদের মোল্লা মাত্র কয়েক মাস ছাত্র ইউনিয়ন করতেন।

তথ্যমতে, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ৪৩তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রথম রায় কার্যকর হয় কাদের মোল্লার ফাঁসির মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা ও ধর্ষণের দায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। নিজের কর্মের জন্য একাত্তরে তিনি ‘কসাই কাদের’ নামে পরিচিতি পান।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মহাজোট সরকারের আমলে। অন্য কোনো রাষ্ট্র বা জাতিসংঘের সাহায্য ছাড়াই মাত্র পৌনে চার বছরের মাথায় একটি মামলার বিচার শেষ করে দণ্ড কার্যকর হয়—বিশ্বে এমন দৃষ্টান্ত খুব একটা নেই। রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসি কার্যকরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসে বাংলাদেশ সাহসী বলে অভিমত দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের।

প্রসঙ্গত, মওদুদি জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আর ছাত্রসংঘ দলটির ছাত্র সংগঠনের সাবেক নাম। আরো পরে এর নামকরণ হয় ‘ইসলামি ছাত্রশিবির’। জামায়াতের বিভিন্ন প্রকাশনা, বই, দলটির নেতাদের বক্তব্যে মার্কসবাদ ও বামধারার রাজনীতিকে ‘নাস্তিক্যবাদ’ বলে দাবি করা হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়ন হচ্ছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ছাত্র সংগঠন।

শেয়ার করুন