নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে এখন গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান কমিটি (সার্চ কমিটি)। দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এর মধ্য দিয়ে গঠিত ইসির অধীনে। সামনের সংসদ নির্বাচন প্রায় একই পদ্ধতিতে গঠন হতে যাওয়া ইসির অধীনে হওয়ার কথা। প্রথম আলোচনায় আসার সময় এ কমিটি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বেশিরভাগ দলের ঐক্যমত্য ছিল। পরে এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। শুরু হয় দলীয় অবস্থান থেকে পক্ষে-বিপক্ষে সুবিধাজনক তর্ক-বিতর্ক। ইসির প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো ওই ঐক্যমত্য ধরে রাখতে পারেনি।
সার্চ কমিটি পদ্ধতির প্রথম প্রস্তাব, ফর্মুলা কোন রাজনৈতিক দলের? কীভাবে, কখন, কেন- সার্চ কমিটির চিন্তা সামনে আসে? প্রথম দুইবার আইন ছাড়া এ কমিটি গঠিত হয়। এবারের কমিটি গঠিত আইনের ভিত্তিতে। নির্দিষ্ট আইন, এতে বর্ণিত কমিটির যথাযথ ক্ষমতা ও স্বাধীনতা থাকার পরও ‘সন্দেহের দোলাচল’ কাটছে না। ২০১১ সালে এ পদ্ধতির কথা রাজনীতিতে প্রথম জোরালো হয়। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত ওই সময়ের ইসির মেয়াদ নির্ধারিত ছিল। এর আগে ইসি গঠনে বিভিন্ন বিষয় সামনে আসে।
তখন সংসদে বিরোধিদল বিএনপি ‘নিরপেক্ষ ইসি’ গঠনের দাবি জানায়। দলটির জোটের শরিক দলগুলোও সংসদের বাইরে একই দাবিতে বক্তব্য দেয়। সরকারি দল আওয়ামী লীগের জোটে থাকা ও সরকারবিরোধি দলগুলোর আস্থার সংকট ফের সামনে আসে। ‘সংকট সমাধানে’ ওই সময়ের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথমবারের মতো সংলাপের আয়োজন করেন।
সংলাপে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল থেকে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাব আসে। এর আগে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে ‘নিরপেক্ষ ইসি গঠনে’ রাষ্ট্রপতির অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাব আসে। বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজন ও দলনিরপেক্ষ নাগরিক প্রতিনিধিরা এতে সমর্থন জানান। জাতীয় সংসদ ও দলীয় সভায় বিএনপি এ কমিটি গঠনের পক্ষে মত দেয়।
তবে আগে পক্ষে বললেও রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নিয়ে বিএনপি ইসি গঠনের আগে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্বহালের’ দাবি করে। দলটির অবস্থান ততোদিনে পাল্টে যায়। দলটি বলে, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের’ পর ইসি নিয়ে আলোচনা করা যাবে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৫ সদস্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেন ২০১২ সালের জানুয়ারিতে।
২০১২ সালে অনুসন্ধান কমিটি গঠনে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তকে বিএনপি ‘প্রত্যাখ্যান’ করে। ওই বছর কমিটির কাছে দলটি কোনো নাম প্রস্তাব করেনি। তবে ২০১৭ গঠিত কমিটিতে দলটি নামের প্রস্তাব করে, এর আগে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নেয় ‘আন্দোলনের অংশ’ হিসেবে। দলটির তালিকা থেকে ইসিতে দায়িত্বও পান। সবশেষ গঠিত কমিটিতে বিএনপি সরাসরি নামের প্রস্তাব করেনি, এর আগে আমন্ত্রণ পেয়েও রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নেয়নি। ইসি গঠনে এ পদ্ধতি ‘একবার কেন ভালো, পরের বার কেন মন্দ’ এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই বিএনপির।
আইন না করলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১২ সালে ইসি গঠনে একটি নতুন পদ্ধতি চালু করেন ওই সময়ে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। কমিটি গঠন করে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবিত নাম থেকে ইসি গঠন করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি অনুযায়ী সম্প্রতি এ বিষয়ে আইন প্রণীত হয়। দলগুলোর আস্থার সংকটের কারণে এক দশক পরও এ পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। গণতন্ত্র ও দেশের স্বার্থে দলগুলো ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারেনি বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তাছাড়া প্রথমবারের মতো নতুন পদ্ধতিতে গঠিত কাজী রকিব উদ্দীন কমিশন কোনো ‘চমক’ দেখাতে পারেনি। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বের দ্বিতীয় কমিশনও নানা বিতর্কে জড়ায়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান মনে করেন, ‘গত দশ বছরে দুটি অনুসন্ধান কমিটি এমন কোনো নাম দিতে পারেনি, যেখান থেকে কমিশনে কোনো সফল ব্যক্তিত্ব এসেছেন। যাদের আসা সম্ভব ছিল, তাদের নাম অনুসন্ধান কমিটি দিতে পারেনি। তাই অনুসন্ধান কমিটি এখনো সফল হয়নি।’
ইসিতে নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটি গঠনে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ২০১২ সালের সিদ্ধান্তকে বিএনপি ‘প্রত্যাখ্যান’ করলেও তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এটিএম শামসুল হুদা একে স্বাগত জানান৷ তবে তিনি এ জন্য আইন চান।তখন গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের যাঁতাকলে গণতন্ত্র পিষ্ট হচ্ছে। ইসির হাতে কিছু ক্ষমতা ও আরো কিছু স্বাধীনতা দিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব৷’ এ জন্য দলগুলোর ঐক্যমত্য দরকার বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, ‘কোনো দেশই বলবে না- নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে। কোনো দেশের নাগরিকরা শতকরা ৭০ ভাগ ভোট নিজের মনোনীত জায়গায় দিতে পারলে সেটাকে আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন বলি। আমাদের দেশে কোনো দল নির্বাচনে হারলে তারা বলে, সবাই আমাদের বিরুদ্ধে ছিল, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ইসি একা সুষ্ঠু নির্বাচন করাতে পারবে, এটা দুনিয়ার কেউ বলতে পারবে না৷’