ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় ধর্ষণের শিকার এক শিশু (১৪) পুত্রসন্তানের মা হয়েছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি শিশুটি সন্তানের মা হলেও গ্রাম্য সালিশদারদের ভয়ে আইনের আশ্রয় নিতে পারেনি ভুক্তভোগীর পরিবার।
শিশুর পরিবারের অভিযোগ, উপজেলার বুড়িশ্বর ইউনিয়নের সিংহগ্রাম গ্রামের হরিদাস ভৌমিক (৫০) ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত। ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সালিশ বৈঠক ডাকেন স্থানীয় মাতবররা। সালিশ বৈঠকে হরিদাসকে দোষী সাব্যস্ত করে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন তারা।
শিশুটির মা জানান, তাদের ভিটেমাটি নেই। পরিবার দরিদ্র হওয়ায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। পাশাপাশি হরিদাস ভৌমিকের বাড়িতে একটি ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। স্বামী ও তিনি কাজে যাওয়ার সুযোগে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে মেয়েকে একাধিকবার ধর্ষণ করে হরিদাস। এতে শিশুটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ছেলেসন্তানের মা হয় শিশুটি। কিন্তু লোকলজ্জা ও সালিশদারদের ভয়ে পুলিশকে বিষয়টি জানাতে পারেননি। এখন আইনের আশ্রয় নিতে চান তারা।
শিশুটির মা আরও জানান, প্রতিবেশীরা নানা ধরনের সমালোচনা করায় এখন আমরা ঘর থেকে বের হতে পারি না। ঘরবন্দি হয়ে আছি সবাই। আমরা এখান থেকে মুক্তি চাই।
এদিকে, এ ঘটনায় ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে গ্রামে সালিশ বৈঠক করেন স্থানীয় মাতবররা। ওই বৈঠকে শিশুটিকে হরিদাসের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত দেন তারা। তবে সেটি চার বছর পর।
শিশুটির বাবা জানিয়েছেন, ধর্ষণের কথা কাউকে বললে মেয়েকে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দিয়েছে হরিদাস। বারবার সালিশদারদের বললেও সমাধানের উদ্যোগ নেননি। উল্টো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সালিশদাররা। তাদের ভয়ে আমি আইনের আশ্রয় নিতে পারিনি।
সালিশ বৈঠক সম্পর্কে তিনি বলেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে গ্রামের শতাধিক মানুষের উপস্থিতিতে সালিশের আয়োজন করে গ্রামবাসী। সালিশে স্থানীয় মাতবর প্রমোদ সাহাজি, সুনির্মল, অনিল ঘোষ, রাম প্রসাদ মল্লিক, মিশু সরকার ও জিতেন্দ্রসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সালিশে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে কিছু শর্ত দিয়ে চুক্তি করা হয়। চুক্তিতে তারা উল্লেখ করেছেন, মেয়ের বয়স ১৮ বছর হলে হরিদাসের সঙ্গে বিয়ে হবে। তাদের এই সালিশের কারণে আমাদের জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলো। আমি এই সালিশ মানি না। আইনের আশ্রয় নিতে চাই। কিন্তু তাদের ভয়ে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
এ ব্যাপারে গ্রাম্য সালিশদার রামপ্রসাদ মল্লিক বলেন, যেহেতু শিশুটির বয়স ১৮ হয়নি তাই আইনগতভাবে বিয়ে দেওয়া যাবে না। এজন্য গ্রামবাসীর সম্মতিক্রমে চার বছর পর বিয়ের সিদ্ধান্ত দিয়েছি আমরা।
আইন-আদালত উপেক্ষা করে গ্রাম্য সালিশে ধর্ষণের বিচার করা যৌক্তিক কিনা জানতে চাইলে রামপ্রসাদ মল্লিক বলেন, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আমরা সেই সিদ্ধান্ত দুই পরিবারকে জানিয়েছি। তারা চাইলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।
এদিকে, অভিযুক্ত হরিদাস ভৌমিকের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেনি। তার ছোট ভাই গৌরদাস ভৌমিক বলেন, ‘আমার ভাই এ ঘটনায় জড়িত নয় বলে আমাকে জানিয়েছেন। তবু গ্রাম্য সালিশে মেয়ের জবানবন্দিতে ভাইকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাই আমাদের বলার কিছু ছিল না। তবে আদালতের মাধ্যমে উভয়ের ডিএনএ পরীক্ষা করার পর আমার ভাই দোষী হলে রায় মেনে নেবো।’
বুড়িশ্বর ইউনিয়নের মেম্বার রতন কান্তি শাহজি বলেন, বৈঠকের দিন এলাকায় ছিলাম না। চেয়ারম্যানের নির্দেশে পরে এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে ঘটনার সত্যতা পেয়েছি।
তিনি বলেন, বিষয়টা অমানবিক এবং দুঃখজনক। শিশুটির মা-বাবা দরিদ্র হওয়ায় তার বাড়িতে বসবাসের সুযোগে হরিদাস এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এরই মধ্যে একাধিকবার নবজাতক শিশুটিকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে পরিবার। পরিবারটি চাপের মুখে থাকায় থানায় মামলা করতে পারেনি। তারা যদি আইনগত পদক্ষেপ নিতে চান তাহলে সহায়তা করবো।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাবিবুল্লাহ সরকার বলেন, আমাদের কাছে আইনি সহায়তার জন্য আসেনি ভুক্তভোগী শিশুর পরিবার। তাই আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারিনি। তারা মামলা করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হালিমা খাতুন বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা আইনি সহায়তা চাইলে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।