দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে অপসারণের (চাকরিচ্যুত) কারণ এবং তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো তথ্য-প্রমাণসহ লিখিত প্রতিবেদন আকারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খানকে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলেছেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগগুলোর স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবীর করা রিট শুনানি পিছিয়ে আগামী ৭ মার্চ পরবর্তী দিন ঠিক করেছেন হাইকোর্ট। এরমধ্যে ১০ জন রিটকারী ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উভয় পক্ষ থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের নির্দেশও দিয়েছেন আদালত। পরে এ বিষয়ে আদেশ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
এদিন আদালতে রিটকারীদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন মো. খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক।
গত বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দুদক থেকে চাকরিচ্যুত হন মো. শরীফ উদ্দিন। এরপর তার ও দুদকের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যমে যে খবর প্রকাশ হয়, সেগুলোর স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী। ওইদিন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ১০ আইনজীবীর পক্ষে রিটটি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। গত ২২ ফেব্রুয়ারি শরীফ উদ্দিনকে অপসারণের বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন এ আইনজীবী।
রিটকারী ১০ আইনজীবী হচ্ছেন- মোহাম্মদ শিশির মনির, রেজওয়ানা ফেরদৌস, জামিলুর রহমান খান, উত্তম কুমার বণিক, মোস্তাফিজুর রহমান, মো. তারেকুল ইসলাম, মীর ওসমান বিন নাসিম, সৈয়দ মোহাম্মদ রায়হান, মো. সাইফুল ইসলাম ও মোহাম্মদ নওয়াব আলী।
রিটে দুদকের চেয়ারম্যান, সচিব, কমিশনার (অনুসন্ধান), কমিশনার (তদন্ত), পরিচালক (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) এবং চাকরিচ্যুত সাবেক উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দীনকে বিবাদী করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আমরা কোনো ব্যক্তির পক্ষে রিট করিনি। আমরা আলোচিত ওই ঘটনায় চাকরিচ্যুত শরীফ উদ্দীন এবং দুদকের পাল্টাপাল্টি যে বক্তব্য গণমাধ্যমে এসেছে, এর তদন্ত চেয়েছি। কারণ, তদন্তেই প্রকৃত সত্য উঠে আসবে। জনমনে বিভ্রান্তি দূর হবে।
তিনি বলেন, এছাড়া স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজনে একটি কমিটি গঠন এবং ওই কমিটি কর্তৃক প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিটে। একইসঙ্গে এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট নথি তলব করে বিষয়টি পর্যালোচনারও আবেদন করা হয়েছে।
এর আগে শরীফ উদ্দিনের জীবনের নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে চিঠির মাধ্যমে আবেদন করেছিলেন এ ১০ আইনজীবী। তবে গত ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একই বেঞ্চে বিষয়টি উপস্থাপন করা হলে এ ঘটনায় সংক্ষুব্ধ আইনজীবীদের যথাযথ আবেদন (রিট) নিয়ে আসার কথা বলেন। সে অনুযায়ী রিট করেন ওই ১০ আইনজীবী।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদক (কর্মচারী) বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২) অনুযায়ী উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। শরীফ উদ্দিন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় পটুয়াখালীতে উপ-সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এর আগে সাড়ে তিন বছর তিনি ছিলেন চট্টগ্রামে। সেখানে থাকাকালে কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণের সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা দুর্নীতির ঘটনায় ১৫৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন তিনি। যে তালিকায় অ্যাডমিন ক্যাডার, পুলিশ কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও ছিলেন।
রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল দুদক, সেসব মামলার বাদী ছিলেন শরীফ। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা সনদ দেওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে আলোচনায় আসেন শরীফ উদ্দিন।
এছাড়া অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ স্থানান্তর ও নতুন সংযোগ দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (কেজিডিসিএল) বিভিন্ন অভিযোগ নিয়েও তদন্ত করেন শরীফ।
পরে অভিযোগের ‘সত্যতা পেয়ে’ কেজিডিসিএলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ছেলে মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজনকে আসামি করে গত বছরের ১০ জুন মামলা করেন শরীফ।
এ মামলা দায়েরের পরই শরিফ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালী বদলি করা হয়। সবশেষে জীবননাশের হুমকি পাওয়ার ১৬ দিনের মাথায় তিনি চাকরিচ্যুত হন।
শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতির পর দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার জন্য যত রকমের কাজ করা যায়, একটাও বাকি রাখেননি শরীফ উদ্দিন।