রাষ্ট্রপিতা (ফাউন্ডিং ফাদার অব দ্য নেশন) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখায় কয়েকটি জেলার কথা এসেছে, সেগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেন বিশেষ জায়গা দখল করে রেখেছে। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নিজের স্মৃতিপটে থাকা ওই জেলার কথা দিনপঞ্জিতে (ডায়েরি) লেখেন। যা গভীর অন্তর্দৃষ্টির, অনির্বচনীয় অনুভবের বর্ণনা।
বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবের লেখায় এসেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের রেল স্টেশন, নবীনগরের কৃষ্ণনগর গ্রাম, ওই গ্রামের বিদ্যালয়, গানের আসরের কথা। এসেছে নদী, নদীর ঢেউ, ভাটিয়ালি গান, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিদের ষড়যন্ত্রের কথা। এসেছে তাঁর ওই সফরে সঙ্গীদের মধ্যে একজন লোক সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদের প্রসঙ্গ।
বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকার সময় দিনপঞ্জিতে লেখেন। ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন তিনি কারারুদ্ধ। তাঁকে ঘাতকরা হত্যার অনেক বছর পর ২০১২ সালে তা বই আকারে প্রকাশিত হয়। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামে। সুখপাঠ্য, তথ্যসমৃদ্ধ, সহজবোধ্য ওই লেখায় এসেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কথা। এতে ওই সময়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
রাষ্ট্রপিতার একদিকে ব্যক্তি হিসেবে চিন্তার মগ্নতা গভীরভাবে রূপায়িত হয়েছে লেখায়, একইসঙ্গে নিজের রাজনৈতিক জীবন তখনকার সময়ের পটভূমিতে চমৎকারভাবে তিনি উঠিয়ে এনেছেন। বঙ্গবন্ধু লেখেন- ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার নবীনগর থানার কৃষ্ণনগরে জনাব রকিবুল হোসেন এক সভার আয়োজন করেন কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের দ্বারোদঘাটন করার জন্য। … সেখানে বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিন, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন আহম্মদ গান গাইবেন। আমাকেও নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল।
… সন্ধ্যায় … গানের আসর বসল। আব্বাসউদ্দীন সাহেব, সোহরাব হোসেন সাহেব ও আমরা রাতে রফিক সাহেবের বাড়িতে রইলাম। …পরের দিন নৌকায় আমরা রওয়ানা করলাম, আশুগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন ধরতে। পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত।
তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম।
তিনি আমাকে বলেছিলেন- মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, পৃষ্ঠা- ১১১)।
বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনকের লেখায় রাজনীতিকের দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, লেখকের দায়বোধও ফুটে উঠেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শিল্পের সুষমা—এটিই তাঁর বইয়ের একমাত্রিক ব্যঞ্জনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাদের জন্মজেলা, তারা বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় নিজের জেলার কথা পড়ে অন্যরকম অনুভূতি, পুলক অনুভব করেন নিশ্চয়! গর্ববোধও করেন! নাড়ির টানের কারণে তা করতেই পারেন! শিল্প, সংস্কৃতি, কবিতার শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কথা তাঁর বইয়ে এসেছে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসার প্রমাণ হিসেবে।
আগামীকাল পড়ুন- পথনাটক, সিনেমায় রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধুর অভিনয়।