ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের প্রশ্নে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। দেশপ্রেম ও দেশের স্বার্থে দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। সরকারবিরোধি অবস্থান ও প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার পরিকল্পনা থেকে দলগুলো কথা বলছে। রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকলেও বিভিন্ন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল নিজ দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান প্রকাশ করছে। এ দেশের দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিরাজমান বিভেদের চিত্র আবার ফুটে উঠেছে দেশের স্বার্থের প্রশ্নেও।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় পার্টিসহ (জাপা) বিভিন্ন দল ইউক্রেনে আগ্রাসনের নিন্দা জানানোর বিষয়ে নানা ‘কৌশল’ অবলম্বন করছে। আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে জোটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে থাকার পরিকল্পনা আছে যেসব দলের, সেগুলো এ বিষয়ে দুটি প্রধান দলের প্রতিক্রিয়ার দিকে নজর রাখছে। রাশিয়ার হামলার প্রশ্নে চীন ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানে বলে দেশের চীনপন্থি বামদলগুলো নিরব। রাশিয়াপন্থি বামদলগুলোও কথা বলছে না। এসব দলের অবস্থান দলীয় স্বার্থে। দেশের প্রশ্নে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি। এ লক্ষ্যে দলগুলোর মধ্যে কোনো উদ্যোগ, বা প্রচেষ্টাও নেই।
রাশিয়ার আগ্রাসনের পর পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে দুটি পক্ষ স্পস্ট। একপক্ষে রাশিয়া ও এর মিত্ররা, অন্যপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। দুইপক্ষের দেশগুলোই বাংলাদেশের কূটনৈতিক বন্ধু হওয়ায় এবং দুইপক্ষের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন স্বার্থ জড়িত থাকায় ইউক্রেনে হামলার প্রশ্নে সরকার এখনো ‘ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক অবস্থানে’ আছে। রাশিয়ার ‘সামরিক অভিযান’ শুরুর প্রতিবাদে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের হামলা বন্ধে পাস হওয়া প্রস্তাবে বাংলাদেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। বিষয়টিকে কূটনৈতিকভাবে বিচার না করে দেশে কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে।
বিষয়টিতে সরকারের ‘কঠোর সমালোচনা’ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাশিয়ার হামলার নিন্দা জানান। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হলে এর পরের নয়দিন পর্যন্ত বিএনপি এ বিষয়ে কোনো কথা বলেনি। জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে দেশের বিরত থাকার তথ্য সামনে এলে দলটির মহাসচিব এ বিষয়ে বক্তব্য দেন। জাতিসংঘের ওই প্রস্তাবে ভারত, চীন, পাকিস্তানসহ ৩৫টি দেশ ভোট দেয়নি। ভারতে বিজেপির নেতৃত্বের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কংগ্রেস সরকারের ওই অবস্থানের সমালোচনা করেনি। দেশটিতে সরকারবিরোধি অনেক দল সরকারের ওই অবস্থানকে স্বাগত জানায়। দেশের স্বার্থে বেশিরভাগ ভারতীয় দল ঐক্যবদ্ধ।
এ দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হতে না পারা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার তখন মিথ্যা কথা বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে ইরাক আক্রমণ করেছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের আহম্মকির কথা জেনেও বিরোধী টোরি পার্টি সংসদে ব্লেয়ারের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। এটা দেশপ্রেম। বাংলাদেশের বিএনপি প্রতিপক্ষ হলে টনি ব্লেয়ারকে তো সমর্থন করতোই না, সাদ্দাম হোসেনকে গোপনে চিঠি লিখত যুক্তরাজ্য আক্রমণের জন্য।’
জাতিসংঘে ইউক্রেন ইস্যুতে ভোট দেওয়া থেকে বাংলাদেশের বিরত থাকার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তাঁরা জানান, ‘দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে আমরা ভোট দিইনি। বাংলাদেশ শান্তির পক্ষে।’ যোগাযোগ করলে বিএনপির মহাসচিব মত ও পথের কাছে অভিযোগ করেন, ‘সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে দেশবাসীর জনমতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে।’
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘে ভোটদানে বিরত ছিল। জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ সব দেশই বিভিন্ন সময়ে অনেক ক্ষেত্রে ভোটদানে বিরত থাকে। এবার যখন জাতিসংঘে এ প্রস্তাব আনা হয়, তখন ভারতসহ অনেক দেশ ভোটদানে বিরত ছিল।’ সব বিষয়ে মতামত দিতে দিতে ‘খেই হারানো’ বিএনপির মহাসচিব ভারতের বিরত থাকার কী ব্যাখ্যা দেবেন, প্রশ্ন রাখেন মন্ত্রী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, ‘বাংলাদেশ ভোট না দিয়ে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে তার অবস্থান জানান দিয়েছে৷ এখন আর আগের মতো অবস্থা নেই যে, চাপ দিয়ে কোনো একটা অবস্থানে যেতে বাধ্য করা যায়৷ বাংলাদেশ সেই অবস্থা পার হয়ে এসেছে৷ কূটনৈতিক সিদ্ধান্তে অনেক বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়৷ এর সঙ্গে দেশের ভেতরের রাজনীতি সব সময় মেলে না৷ তাই কূটনৈতিক সিদ্ধান্তকে কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা ভালো৷’
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ১৪ দলের জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এ প্রসঙ্গে মত ও পথকে বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতিসংঘে ভোট দেওয়া থেকে বিরত রেখেছে নিজেকে। আমার মনে হয়, এটি ঠিক হয়েছে।’