‘চেয়ারম্যান’ শব্দের পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন নারী জনপ্রতিনিধিরা

মত ও পথ রিপোর্ট

চেয়ারম্যান শব্দের বদলে চেয়ারপারসন পদবির দাবি তুলেছেন নারী জনপ্রতিনিধিরা

দেশে চেয়ারম্যান পদটিতে এতদিন একচেটিয়া আধিপত্য ছিল পুরুষদের। হয়তো সবার ধারণা ছিল, এই পদে কোনও নারী কখনও আসবেন না। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা থেকে এই শব্দের উদ্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন অনেক নারী জনপ্রতিনিধি। এজন্য চেয়ারম্যান শব্দের বদলে চেয়ারপারসন পদবির দাবি তুলেছেন তারা। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার দুপুরে বরিশালে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সদর উপজেলার টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাদিরা রহমান নারীদের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান শব্দ বাদ দিয়ে চেয়ারপারসন পদবি ব্যবহারের দাবি জানিয়েছেন। তার সঙ্গে একই দাবি তুলেছেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত অপর নারী চেয়ারম্যানরা। এদিন ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত ৫ নারী চেয়ারম্যান এবং সাধারণ মেম্বার পদে নির্বাচিত আট জনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অবদান রাখা নারীদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বরিশাল সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার আমিন উল আহসান।

পঞ্চগড় পৌরসভার মেয়র জাকিয়া খাতুন বলেছেন, ‌পৌরপিতা, চেয়ারম্যান ও মেয়র শব্দগুলো দেখলেই বোঝা যায় পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা থেকে এসব শব্দের উদ্ভব। নারীর ক্ষমতায়নের কথা শুধু মুখে বললে হবে না। সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে হবে।

জয়পুরহাটের কালাই পৌরসভার মেয়র রাবেয়া সুলতানা বলেন, পুরুষতান্ত্রিক হলেও মেয়র শব্দটি এখন সবার পরিচিত। মেয়র পদবি সংশোধনের চেয়ে বড় কথা হলো, সব ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার, সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, নারী ও কন্যাদের সম্পদ-সম্পত্তিতে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবেই ক্ষমতায়নের পথে নারীর অগ্রযাত্রা সুগম হবে।

‘চেয়ারম্যান’ শব্দ নিয়ে যা বলছেন নারী জনপ্রতিনিধিরা

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পুতুল রানী দাস বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আমাকে সবাই চেয়ারম্যান বলে ডাকেন। লক্ষ করলে দেখবেন ‘ম্যান’ শব্দটি পুরুষতান্ত্রিক। শব্দটি নারীর সঙ্গে যায় না। নারীদের ক্ষেত্রে যদি চেয়ারপারসন শব্দটি ব্যবহার করা হতো তাহলে ভালো লাগতো। আশা করি, সরকারের দায়িত্বশীলরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন। শব্দটি সংশোধনের প্রয়োজন।’ সরাইল উপজেলার শাহজাদাপুর ইউনিয়নের নারী চেয়ারম্যান আসমা আক্তারও একই কথা বলেছেন।

কক্সবাজারের রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খোদেস্তা বেগম রীনা বলেন, চেয়ারম্যান শব্দটি শুধু চেয়ারপারসন করলেই হবে না। সব ক্ষেত্রে নারীদের সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এরই মধ্যে নারীরা অনেক এগিয়ে গেছে। তবে সামাজিক ও আর্থিক দিক অনেক পিছিয়ে আছে নারীরা। এজন্য নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে হবে। তাহলে নারীরা আরও এগিয়ে যাবে।

বরিশাল সদরের টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাদিরা রহমান বলেন, একজন পুরুষ প্রার্থীকে পরাজিত করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছি। নির্বাচিত হওয়ার পর আমাকে সবাই যখন চেয়ারম্যান নাদিরা রহমান বলা শুরু করলেন, তখন অনুধাবন করলাম নারীদের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান শব্দটি ব্যবহার সঠিক নয়। শুনতে আমার ভালো লাগে না। এক্ষেত্রে চেয়ারপারসন পদবি হলে ভালো হতো। শব্দটি সংশোধনের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেবো।

পিরোজপুর মঠবাড়িয়া উপজেলার ৮ নম্বর আমড়াগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শারমিন জাহান বলেন, নির্বাচনে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ছয় জন পুরুষ। ইউনিয়নে আমি প্রথম নারী চেয়ারম্যান। মানুষ যখন আমাকে চেয়ারম্যান ডাকে তখন বিব্রতবোধ করি। কারণ, শব্দটি নারীর সঙ্গে যায় না। আমি এটির পরিবর্তন চাই। একই সঙ্গে সারাদেশে নারী চেয়ারম্যানদের ক্ষেত্রে চেয়ারপারসন শব্দ ব্যবহার করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানাই।

বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার ১ নম্বর তেলীগাতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোর্শেদা আক্তার বলেন, চেয়ারম্যান পুরুষও হতে পারে নারীও হতে পারে। এ নিয়ে আমার আপত্তি নেই। তবে সব ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা ছিল, এটি বাস্তবায়ন হয়নি আজও। নারীদের ক্ষেত্রে বৈষম্য ও অসমতা দূর করা এখন জরুরি।

ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার দত্তেরবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রোকসানা আক্তার বলেন, নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান শব্দটি বহু আগে থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে শব্দটি সংশোধনের চেয়ে বেশি জরুরি, সব ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

পটুয়াখালী সদরের বদরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তানজিন নাহার সোনিয়া বলেন, পুরুষের চেয়ে নারীরা কোনও অংশে পিছিয়ে নেই। একজন পুরুষ যদি চেয়ারম্যান হতে পারে তাহলে আমি কেন পারবো না? জনগণ আমাকে চেয়ারম্যান বলে ডাকে, এতে আপত্তি নেই। তবে নারীর সমঅধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যদিও কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে আছে নারীরা। ক্ষমতায়ন ও সর্বস্তরে নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই বৈষম্য দূর হবে।

রংপুরের পীরগঞ্জের বড়দরগা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাফিয়া আখতার শিলা বলেন, চেয়ারম্যান শব্দটি পুরুষতান্ত্রিক এতে কোনও সন্দেহ নেই। চেয়ারপারসন শব্দটি থাকলেও সেটি নারী চেয়ারম্যানদের বেলায় ব্যবহার করা হয় না। এছাড়া সাধারণ মানুষের কাছে চেয়ারম্যান শব্দটি বহুল প্রচলিত। তবে কেউ আমাকে চেয়ারম্যান বললে শুনতে খারাপ লাগে না। আমার বাবা দীর্ঘদিন এখানের চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন গ্রামের মানুষ ‘চেয়ারম্যান বেটি’ বলে দূর থেকে ডাক দিলে আমার শুনতে ভালো-ই লাগে।

সাতক্ষীরা কলারোয়ার জয়নগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিশাখা সাহা বলেন, ‌চেয়ারম্যান, চেয়ারম্যানই। এখানে নারী-পুরুষ বলে ভেদাভেদ লক্ষ করিনি। এই চেয়ারটাতে পুরুষের যেমন অধিকার নারীরও সমান অধিকার। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে পুরুষ-নারী যে কেউ চেয়ারম্যান হতে পারে। সবার কাজই সমান। কাজেই নারীদের জন্য চেয়ারম্যান শব্দ পরিবর্তন করার দরকার আছে বলে মনে হয় না।

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান সাফিয়া পারভীন বলেন, পুরুষ কিংবা নারী; চেয়ারম্যান জনগণের সেবক। জনগণের জন্য কাজ করলেই হলো। তবে নারীর ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হবে। নারীর অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে।

বরগুনার আমতলী উপজেলার আড়পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেলী পারভীন মালা বলেন, ‌দীর্ঘদিন ধরে ইউনিয়ন পরিষদ প্রধানের এই পদটিকে চেয়ারম্যান হিসেবে ডাকা হয়। তবে এখানে নারী-পুরুষ বিবেচনায় পদ বৈষম্য করা উচিত নয়।

শেয়ার করুন