‘ক্ষুধা বোমা বিস্ফোরণের’ শঙ্কা আ.লীগের শরিক দলগুলোর

হাসান শান্তনু

শুধু সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ১৪ দলীয় জোট ও মহাজোটের শরিক দলগুলোও দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির প্রশ্নে সরকারের সমালোচনায় সামিল হয়েছে। তাদের আশঙ্কা, দেশে ‘ক্ষুধা বোমার বিস্ফোরণ’ ঘটতে পারে।! এতে ‘সবকিছু ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন’ হয়ে যেতে পারে। এমনকি সুবর্ণজয়ন্তীর আনন্দ অচিরেই ‘বিপদে’ পরিণত হতে পারে। দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। এখনই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ‘নিরব দুর্ভিক্ষ’ দেখা দেবে বলেও শরিক দলগুলোর শীর্ষনেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করলেও নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামের প্রশ্নে এবারই তারা ‘কঠোর’ সমালোচনা করছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকারের মিত্র দলগুলো বলছে, নিত্যপণ্যের বাজার আমদানিকারক, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতাদের হাতের মুঠোয় চলে গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সংসারের নিত্যপণ্যের এ অস্বাভাবিক দাম বাড়ানো দুর্নীতিবাজ চক্রের কারসাজি। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য কিছু বাড়লেও ‘নিম্নবিত্তদের ক্রয়ক্ষমতা তিনগুণ বেড়েছে’। ‘সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে তা বন্ধের আহবান জানিয়েছে শরিকরা। রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধের অজুহাত তুলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলেও তাদের দাবি।

universel cardiac hospital

১৪ দলের জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন মত ও পথকে বলেন, ‘সরকার কার্যত ক্ষুধা বোমার ওপরে বসে আছে। এর বিস্ফোরণ ঘটলে সবকিছু ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সুবর্ণজয়ন্তীর আনন্দ অচিরেই বিপদে পরিণত হবে। সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস মধ্যবিত্ত, নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে পৌঁছে দিতে অবিলম্বে পূর্ণ রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা উচিত।’

তিনি বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত তুলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যবসায়ীরা স্বীকার করেছেন, তাদের কাছে পর্যাপ্ত ভোজ্যতেল আছে। তারা শুধু ভ্যাট মওকুফ চান। এ অবস্থায় বাজার থেকে ভোজ্যতেল উধাও হওয়ার কোনো কারণ নেই। টিসিবির মাধ্যমে পণ্য সরবরাহে বিশৃঙ্খলা বন্ধ করার জন্যই শুধু নয়, গণবণ্টন ব্যবস্থার যথাযথ বিবেচনায় এখনই পূর্ণ রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।’

১৪ দলের জোটের শরিক জাসদের সভাপতি, সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘অর্থনীতির ঘর থেকে দুর্নীতিবাজদেরকে বিতাড়িত করার মধ্য দিয়ে দেশে রাজনৈতিক শান্তি আসবে। নিত্যপণ্যের উৎপাদন ভালো, বাজারে সরবরাহ ভালো, আমদানিতেও কোনো সমস্যা নেই। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম বাড়ানো দুর্নীতিবাজ চক্রের কারসাজি। সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের দায় এড়ালে চলবে না, সরকারকেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কর্তা ব্যক্তিদের দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তিও বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতির চক্রকে ধংস করার সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।’

তিনি বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমি নিন্দা করছি। আমি মনে করি, এটা বাজার চক্রের কারসাজি, যা নিয়ন্ত্রণযোগ্য। নিত্যপণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা সম্ভব। সামনে রমজানের জন্য প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য আমদানি হয়ে গেছে। সেসব পণ্যের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই।’

মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষ ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছেন। এখনই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশে নিরব দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে টিসিবির গাড়ির সামনে মানুষের লম্বা সারি দিন দিন বাড়ছে। এরই মধ্যে ভিক্ষুকের সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। টিসিবি নয়, রেশনিং কার্ডে আসতে হবে। প্রয়োজনে অন্য প্রকল্প থেকে টাকা এনে সরকারকে ভুর্তকি দিতে হবে।’

বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে কাবু হয়ে গেছেন নানা পেশার মানুষ। আয় কমে যাওয়ায় ধারদেনার জীবনযাপনে টানাপোড়েন চলছে। এর মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম ধাপে ধাপে বেড়ে চলায় সংসার চালাতে দিশেহারা অবস্থা নিম্ন, মধ্যবিত্ত, উপমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর। সাধারণ মানুষের বড় চারটি খাতের খরচ বেড়েছে। খাদ্য ও ঘরের নানা উপকরণ কেনা, বাসাভাড়া ও সেবাখাতের বিল, সন্তানদের পড়াশোনা, পরিবহন খরচ ক্রমেই বাড়ছে। সয়াবিন তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় চরম নাভিশ্বাস অবস্থায় পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। সরকার করোনাকালীন যেসব আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছে, তার আওতায় আসেননি মূলত শহরবাসী এসব নাগরিক। তারা সংখ্যায় অনেক বেশি।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ন্যায্যমূল্যের চার ধরনের ভোগ্যপণ্যের জন্য ঢাকায় ট্রাকের সামনে দীর্ঘ সারি হচ্ছে মানুষের৷ সামাজিক সংকোচ ভুলে এখন মধ্যবিত্তরাও সারিতে দাঁড়াচ্ছেন নিম্ন-মধ্যবিত্তদের সঙ্গে। বিশ্ব বাজারে বেড়েছে সার, জ্বালানি তেল, এলএনজি গ্যাসের দাম। এতে করে দেশীয় বাজারেও এসব পণ্যের দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে থাকায় সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে।

নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম বাড়ার প্রতিবাদে আগামী ২৮ মার্চ আধা বেলা হরতাল ডেকেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। আজ শুক্রবার ঢাকার মুক্তি ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন জোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক। ওই দিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত হরতাল কর্মসূচি পালন হবে।

সাইফুল হক মত ও পথকে বলেন, ‘প্রতিদিন ভোক্তাদের পকেট থেকে সিন্ডিকেট হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আমদানিকারক, মিলার, আড়তদার, মজুতদার, ফড়িয়া, মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরকারের অশুভ আঁতাতের কারণে প্রতিটি খাদ্যপণ্যের দাম আজ আকাশচুম্বী।’

শেয়ার করুন