ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ শিকলে, এই যুদ্ধের ফলে একটি ভয়াবহ খাদ্য সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে বিশ্ব, যা লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর সঙ্গে আলাপকালে এমন মন্তব্য করেছেন খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান ইয়ারা ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী ভেইন তোরে হোলসেথার।
প্রাকৃতিক গ্যাসের রেকর্ড দামের কারণে তার প্রতিষ্ঠান সার উৎপাদনকারী ইয়ারা ইন্টারন্যাশনাল ইউরোপে অ্যামোনিয়া ও ইউরিয়ার উৎপাদন ৪৫ শতাংশ কমাতে বাধ্য হয়েছে। এই দুইটি প্রয়োজনীয় কৃষি উপাদানের স্বল্পতা দেখা দিলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন তিনি।
হোলসেথার সিএনএন বিজনেসকে বলেন, খাদ্য সংকট দেখা দেবে কিনা, বিষয়টি এমন নয়। বিষয়টি হচ্ছে, এই সংকট কতটা ব্যাপক হবে।
গমের সরবরাহ ও দাম
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। তবে এটিকে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে মস্কো। এই অভিযান শুরুর দুই সপ্তাহের মাথায় অঞ্চলটিতে উৎপাদিত প্রধান কৃষি পণ্যগুলোর দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গম। দুনিয়াজুড়ে গম বাণিজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশই আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। এ সপ্তাহের গোড়ার দিকে দুনিয়াজুড়ে গমের দামে সর্বোচ্চ রেকর্ড তৈরি হয়।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো সারের যথেষ্ট উৎপাদন ও এর সরবরাহ ব্যবস্থা। ফসলের জন্য সারের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা অপরিহার্য। এখন ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া থেকে রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। আগে কখনও এটি এতো বেশি ব্যয়বহুল ছিল না।
ইউরিয়ার মতো নাইট্রোজেন-ভিত্তিক সারের মূল উপাদান প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্রমবর্ধমান মূল্যের কারণে ইউরোপেও উৎপাদন কমে গেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিপদের আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ওদিকে ভুট্টা, সয়াবিন এবং উদ্ভিজ্জ তেলের দামও বেড়েছে।
সংকটের আশঙ্কায় মজুত
শুক্রবার জি৭ দেশগুলোর কৃষিমন্ত্রীরা জানিয়েছেন, খাদ্য সংকট মোকাবিলায় ‘যা যা করা দরকার সেগুলো করতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকটের আশঙ্কায় ইতোমধ্যে অনেক দেশ নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ঘাটতি মেটাতে মজুতের দিকে ঝুঁকছে। এতে করে শেষ পর্যন্ত গরিব মানুষকেই ভুগতে হবে।
খাদ্য মজুত নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের মধ্যেই গম, আটা, মসুর ও মটরশুটি রফতানি নিষিদ্ধ করেছে আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র মিসর। ইন্দোনেশিয়ায় পাম তেল রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়েছে। রান্নার তেলের পাশাপাশি প্রসাধনী ও চকলেটের মতো কিছু প্যাকেটজাত পণ্যেও এটি ব্যবহার করা হয়।
বিভিন্ন দেশের প্রতি ‘তাদের খাদ্য ও কৃষি বাজার উন্মুক্ত রাখতে এবং রফতানিতে যে কোনও অযৌক্তিক বিধিনিষেধমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার’ আহ্বান জানিয়েছেন জি৭ ভুক্ত দেশগুলোর মন্ত্রীরা।
জি৭-এর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও অস্থিরতা বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির বিষয়টিকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।’ বিশেষ করে অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে এই জোট।
পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যাদের কৃষি ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী তাদের পক্ষেও এই ক্ষতি পুরোপুরি উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না। এসব দেশের ভোক্তারাও ইতোমধ্যে মূল্যবৃদ্ধির ঘটনায় হতবাক হয়ে পড়েছে এবং পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে।
রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগেই বিশ্বব্যাপী খাদ্য ব্যবস্থায় চাপ তৈরি হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া প্রায় এক দশকের মধ্যে খাদ্যদ্রব্যের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। করোনা মহামারিতে লাখ লাখ মানুষের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টিও একটি সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এই মাসেই জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, ২০১৯ সালে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে থাকা মানুষের সংখ্যা ২৭ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ৪৪ মিলিয়নে পৌঁছেছে। এর মধ্যেই এখন রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছে বিশ্ব। এই সংঘাত বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিশ্বব্যাপী গমের দাম রেকর্ড উচ্চতা থেকে কিছুটা কমেছে, তবে এখনও এর দাম ঢের বেশি। রাবোব্যাংকের কমোডিটি বিশ্লেষক কার্লোস মেরার ধারণা, দাম কিছু সময়ের জন্য এভাবেই থাকবে।
চাষাবাদের মৌসুমে যুদ্ধ
সূর্যমুখী তেলের বৈশ্বিক রফতানির অর্ধেকই আসে ইউক্রেন থেকে। ওদিকে দেশটিতে শুরু হতে যাওয়া গম রোপণের মৌসুম যুদ্ধের ফলে ব্যাহত হবে। জমি চাষ করার জন্য হয়তো সেখানে পর্যাপ্ত কৃষক থাকবে না। কারণ দেশ রক্ষায় অনেকেই অস্ত্র হাতে নেবে। তাছাড়া চাষের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সরঞ্জামের সরবরাহ নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে, যেগুলো সাধারণত কৃষ্ণ সাগর হয়ে আসে।
বিশ্লেষক কার্লোস মেরার মতে, ইউক্রেন এই বছরের বাকি সময় বা পরের বছর কিংবা অদূর ভবিষ্যতে কিছু রফতানি করতে পারবে কিনা সেটি এখনই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।
রাশিয়া থেকেও বিশ্ববাজারে পণ্যসামগ্রী সরবরাহ আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। কারণ একদিকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, অন্যদিকে যুদ্ধরত একটি দেশের কাছাকাছি ভ্রমণের ঝুঁকি হয়তো অনেকেই নিতে চাইবে না।
মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য ‘ব্রেড বাস্কেট’ হিসেবে কাজ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এখন যুদ্ধাবস্থার ফলে স্বভাবতই দেশ দুটির কাছ থেকে আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এগ্রিকালচার মার্কেট ইনফরমেশন সিস্টেমের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এই সরবরাহকারীদের কাছ থেকে উৎপাদন ও রফতানির যে কোনও গুরুতর ব্যাঘাত নিঃসন্দেহে দাম আরও বাড়িয়ে তুলবে। এটি লাখ লাখ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বিনষ্ট করবে।’
সিএনএন অবলম্বনে।