নিবন্ধের শুরুতে বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের ‘শিশুতীর্থ’ কবিতার কিছু পঙ্ক্তি উপস্থাপন করতে চাই-‘‘কেউ বা অলক্ষিতে পালিয়ে যেতে চায়, পারে না;/ অপরাধের শৃঙ্খলে আপন বলির কাছে তারা বাঁধা।/পরস্পরকে তারা শুধায়, ‘কে আমাদের পথ দেখাবে।’/ পূর্ব দেশের বৃদ্ধ বললে, ‘আমরা যাকে মেরেছি সেই দেখাবে।’/ সবাই নিরুত্তর ও নতশির।/ বৃদ্ধ আবার বললে, ‘সংশয়ে তাকে আমরা অস্বীকার করেছি,/ ক্রোধে তাকে আমরা হনন করেছি,/ প্রেমে এখন আমরা তাকে গ্রহণ করব,/ কেননা, মৃত্যুর দ্বারা সে আমাদের সকলের জীবনের মধ্যে সঞ্জীবিত, সেই মহামৃত্যুঞ্জয়।’/সকলে দাঁড়িয়ে উঠল, কণ্ঠ মিলিয়ে গান করল, ‘জয় মৃত্যুঞ্জয়ের জয়।”
অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন মুক্তির মহানায়ক স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লিখেছেন-‘সুচিন্তিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব, শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রমাণ সমগ্র পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির বন্ধু ও অধিনায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক ও মহাননেতা।
তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সভ্যতা, সর্বজনীন শিক্ষা-ব্যবস্থা, সব মানুষের মানবাধিকারের স্বীকৃতি। তার সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবীও স্বীকার করবে এ আশা আমাদের আছে এবং থাকবে।’ প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবন-চরিত, আদর্শিক-রাজনৈতিক ও বাঙালির-মুক্তি নেতৃত্বের গভীরে প্রোথিত ছিল বিশাল মহিমা ও মহানুভব চিন্তা-চেতনার নিরঞ্জন বিচয়ন। পরম শ্রদ্ধেয় অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের ভিত্তিতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর সার্থকতা তিনি শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি; একটি জাতি-রাষ্ট্র তথা সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এবং তা বাস্তবায়নের পথ-নির্দেশনা দিয়েছেন, যার আলোকে তার সুযোগ্য তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সমগ্র জাতির আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করে অদম্য অগ্রগতিতে অবিচল নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধুর অত্যুজ্জ্বল সামাজিক-রাজনৈতিক অভিযাত্রায় (১৯৩৪-১৯৭৫) সপ্তম শ্রেণি থেকে প্রতিটি দিনক্ষণ জীবনপ্রবাহের এক একটি অধ্যায়ের নবতর সংস্করণ। ‘বেরিবেরি’ ও ‘গ্লুকোমা’ নামক হৃদ-চক্ষুরোগে আক্রান্ত বঙ্গবন্ধু শৈশবকাল থেকেই স্বদেশি আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে নেতাজী সুভাষ বসুর আদর্শিক চেতনায় প্রক্ষিপ্ত হলেন। গৃহশিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মহোদয়ের সান্নিধ্যে গরিব শিক্ষার্থীদের সহযোগিতাকল্পে ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হলেন এবং অকপটে সহপাঠীদের নিয়ে মুষ্টিভিক্ষার চাল সংগ্রহ করতেন। ফুটবল, ভলিবল, হকি খেলায় পারদর্শিতা প্রদর্শনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকুতোভয় খেলোয়াড়। পাশাপাশি প্রিয় পিতার মতোই আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জে বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ও শ্রমমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সাহেবের আগমনকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু নির্ভীক রাজনীতিকের উপচীয়মান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ঋদ্ধ হলেন। সূচনায় যেন জয় করলেন নিজেকে এবং ব্রতী হলেন দেশমাতৃকার মুক্তির স্বপ্নে বিভোর আত্মত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত স্থাপনে বৈদগ্ধ চারণ।
মিঞা মুজিবুর রহমান রচিত ‘জাতির জনকের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা’ গ্রন্থে ১৯৭০ সাল থেকে ২০ বছর বাংলাদেশে বসবাসকারী জেমস জে নোভাক রচিত ‘Bangladesh: Reflections on the Water’ পুস্তকের উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য-‘শেখ মুজিব রাজনৈতিক পরিবেশে এক ধরনের তাৎক্ষণিতা নিয়ে আসেন। সূক্ষ্ম কূটচাল অথবা খাপছাড়া পদক্ষেপ নিয়ে তিনি জনগণকে ক্লান্ত করতেন না। সরকারি পদের প্রতি তার কোনো মোহ ছিল না। তার উত্থানের সময় থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর দিনে তাকে গ্রেফতার করা পর্যন্ত সবাই জানত এবং বুঝত তিনি স্বাধীনতার পক্ষেই কথা বলেছেন।’ ১৯৫৫ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রতিটি সাল বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাসে অচ্ছেদ্য অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন ঘটে। শুরু হয় অর্থনৈতিক মুক্তির অর্থবহ স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্ব।
বঙ্গবন্ধুর জীবন-সমাজ-রাষ্ট্র-শিক্ষা-উন্নয়ন দর্শনের ন্যায়ালয় ছিল বাংলার মাটি-মানুষের ন্যায্য সুদৃঢ়তা। হৃদয় নিংড়ানো বাঙালি জাতিসত্তাই ছিল এর নয়নাভিরাম ভিত্তি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বীয় নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীন দেশের মাটিতে পদার্পণ করেই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে অগণিত বাঙালির অশ্রুসিক্ত জনসমাবেশে নতুন করে উচ্চারণ করলেন-‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি, আমি হাসতে হাসতে যাব। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান। আজ আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি। আমার ভাইদের কাছে, আমার মা’দের কাছে। আমার বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন। বাংলার মানুষ আজ আমার স্বাধীন।’ আধুনিক চীনের জনক ‘সান ইয়াত সেন’ যেমন রাষ্ট্র ও জনকল্যাণে জাতীয়তা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ত্রয়ী-নীতি ধারণ করে দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার চার স্তম্ভকে প্রতিষ্ঠিত করার নিরবচ্ছিন্ন ও নিরলস কর্মযজ্ঞে নিজেকে নিবেদন করেন।
ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকা প্রকাশ করে, ‘তাহার এই মুক্তি বাংলাদেশকে বাঁচার সুযোগ দিয়াছে। ইহার আগে দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানের কারাপ্রকোষ্ঠে অন্তরীণ থাকাকালে তাহার জীবন নাশের উপক্রম হইয়াছিল। প্রহসনমূলক বিচারের রায় অনুযায়ী তাহার ফাঁসি নিশ্চিত করার জন্য কবরও খনন করা হইয়াছিল। এই সময় তিনি বীরের ন্যায় বলিয়াছিলেন, আমার লাশটা বাংলার মানুষের কাছে পাঠিয়ে দিও। কোনো প্রলোভন ও ভয়-ভীতিই তাহাকে বাঙালির জনদাবি ও গণতান্ত্রিক আদর্শ হইতে বিচ্যুত করিতে পারে নাই।’ আমাদের সবারই জানা আছে, ১৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ অক্ষুণ্ন রেখে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ঠিক পরের দিন রমনা রেসকোর্স ময়দানকে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান নামকরণের ঘোষণা এবং সরকারি আদেশে মদ, জুয়া, হাউজিসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন। ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে হাইকোর্ট অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে হাইকোর্ট গঠন করেন। দেশে উচ্চশিক্ষার প্রসারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ২১ জানুয়ারি ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেন। ২৪ জানুয়ারি পাক-সামরিক জান্তাদের সহযোগী হয়ে এদেশে যারা মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধকর্মে জড়িত বা দালালি করেছে, তাদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
৩০ ও ৩১ জানুয়ারি মুক্তি ও মুজিব বাহিনীর সব সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর কাছে তাদের রক্ষিত অস্ত্র সমর্পণ করে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই বিতরণের ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শোষণমুক্ত সোনার বাংলা কায়েমই আমাদের লক্ষ্য।’ বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনন্দিত গণতন্ত্রের ভারতকন্যা প্রয়াত শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে ঢাকায় আসেন এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২৫ বছরের জন্য শান্তি, সহযোগিতা ও মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৬ মার্চ দেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালন এবং সব ব্যাংক, বীমা ও বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ঘোষণা করা হয়। ৮ মে সারা দেশে কবিগুরুর জন্মদিন যথাযথ মর্যাদায় পালন এবং ২৪ মে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু তার পরিবারকে একটি ভবন ও রাষ্ট্রীয় ভাতা মঞ্জুর করেন। ২৫ মে বিদ্রোহী কবির উপস্থিতিতে অত্যন্ত আড়ম্বর পরিবেশে তার জন্মদিন পালন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর নির্বিকল্প নতুন আদর্শের নবতর নিলয় হয়েছে বাঙালির আজন্ম লালিত গন্তব্য। সৈয়দ শামসুল হকের ভাষায়-যেখানে ঘুমিয়ে আছো, শুয়ে থাকো বাঙালির মহান জনক তোমার সৌরভ দাও, দাও শুধু প্রিয়কণ্ঠ শৌর্য আর অমিত সাহস টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামগুলো তোমার সাহস নেবে, নেবে ফের বিপ্লবের দুরন্ত প্রেরণা। বিশ্বের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীর জ্যোতির্ময়-মাঙ্গলিক ও নান্দনিক শুভক্ষণে দেশে কদর্য আবরণে আচ্ছাদিত সব অশুভ অন্ধকারের ধূসর কুয়াশা তিরোধানে জাতি নবতর প্রেরণা ও প্রণোদনায় উদ্ভাসিত হোক-এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়