বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ অবিচ্ছিন্ন শব্দ : মোকতাদির চৌধুরী

মোহাম্মদ সজিবুল হুদা

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ দুটি অবিচ্ছিন্ন শব্দ। একটি শব্দ থেকে আরেকটি শব্দ আপনি বিচ্ছিন্ন করতে পারবেন না।

১৭ মার্চ (বৃহস্পতিবার) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে নিয়াজ মুহাম্মদ স্কুল মাঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।

universel cardiac hospital

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস- হাজার বছর অতিক্রম করা ইতিহাস। প্রায় দুই থেকে আড়াই বছরের ইতিহাস হলো বাংলাদেশের ইতিহাস। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের কথা যদি বলেন, বাংলা ভাষাভাষীদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র- একথা যদি বলেন, তাহলে আপনি বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ যে অবিচ্ছেদ্য, এটা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে।

তিনি বলেন, নেতা জি সুভাষ চন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস,শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এই তাবৎ বড় নেতাদের স্মরণ করেও আমি বলব, বঙ্গবন্ধু তাঁদের মধ্যে এক অনন্য অবস্থানে আছেন। সেই স্থান অতীতে কেউ গ্রহণ করতে পারেননি, ভবিষ্যতেও কেউ এই স্থান দখল করতে পারবেন না। সেই স্থানটি হলো একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতা। এখানে অন্য করো অংশীদারত্ব নেই।

প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, শেরে বাংলা অনেক সময় বলতেন, ‘বাঙালিরা হলো এমন একটি জাতি- তারা হলো ব্যাঙের মতো। ব্যাঙকে যেমন এক পাল্লায় উঠিয়ে বসিয়ে রাখা যায় না, লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ে যায়, তেমনিভাবে সমগ্র বাঙালি জাতিকে একত্র করে একটি অভিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করা খুবই কঠিন ব্যাপার।’ কিন্তু এই কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর কর্মকাণ্ডের দ্বারা প্রমাণ করেছেন, সমগ্র বাঙালি জাতিকে একত্রিত করা যায়, তাদেরকে একটি অভিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করা যায়। বঙ্গবন্ধুর মাথায় ১৯৪৬ সালের ইউনাইটেড সোস্যালিস্ট বেঙ্গলের ধারণা, যেটা শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নেতা জি শরৎ বোস, ব্যারিস্টার কিরন শংকর রায় এবং মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসিমের দ্বারা সেইদিন উত্থাপিত হয়েছিল; সেই ধারণাটি তাঁর ভেতরে ছিল। মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস, এই দুইটি রাজনৈতিক দল এবং হিন্দু মহাসভা, যারা সেদিন ভারতের স্বাধীনতার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, তাদের একটি নষ্ট অবস্থানের জন্য সেসময় বাংলাকে আলাদাভাবে একটি রাষ্ট্র করা যায়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মাথায় এটি ছিল।

তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে বঙ্গবন্ধু ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন, এই পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরা কোনো দিন অধিকার নিয়ে সামনে এগুতে পারবে না, তাদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র দরকার। তারই প্রস্তুতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন। বাংলার সংস্কৃতির যে আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে; যেটি ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ১৯৪৬ সালে বলে গেছেন, ‘বাঙালিদের সংস্কৃতি এমনই, বাঙালিদের জাতীয়তাবোধ এমনই, এখানে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের সাথে কখনোই তারা একত্রে বসবাস করতে পারবে না।’ সেটি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর জানা ছিল। আর সেকারণেই ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৪, ৫৫, ৫৮, ৬২ হয়ে ছেষট্টিতে এসে বঙ্গবন্ধু বললেন, বাংলা কীভাবে সামনে এগুতে পারবে তারজন্য তোমাদের সামনে আমি একটা প্রস্তাবনা দিলাম, যেটাকে ছয়দফা বলা হয়েছে।

সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছেন, ‘আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূল বক্তব্য এই ছয়দফাতে আছে।’ সেটাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী সময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু আকাশ থেকে ছুটে আশা কোনো দেবতা নন, এই মাটি এবং মানুষের মধ্য থেকে তিনি বেড়ে উঠেছেন। তিনি খাজা নাজিমুদ্দিনের মতো নবাব পরিবার থেকে আসেননি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস কিংবা নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসুর মতো অভিজাত পরিবার থেকে আসেননি, তিনি একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন, যার সাথে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর (যারা হলো বাংলার আসল শক্তি) ওতোপ্রোতভাবে সম্পর্ক ছিল।

পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ের এই প্রতিরোধযোদ্ধা আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু সবসময় দৃঢ়চেতা ছিলেন, তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে খুবই অনড় ছিলেন। আপনারা হয়তো জানেন না, আওয়ামী লীগ একসময় সিয়াটো-সেন্টোর সদস্য হয়েছিল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী সিয়াটো-সেন্টোর সদস্য হিসেবে পাকিস্তানকে দেখতে চেয়েছিলেন, ওনি পশ্চিমা গণতান্ত্রে ও রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যদিও পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তিনি কখনোই সিয়াটো-সেন্টো মেনে নেননি। শুধু তাই নয়, সোহরাওয়ার্দী যখন বললেন ‘আমি প্রধানমন্ত্রী হওয়াতে পূর্ববাংলা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে’ এই তত্ত্ব কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করেননি। তিনি এই তত্ত্বের বিরুদ্ধেই ছিলেন। এমনকি ১৯৫৬ সালে সোহরাওয়ার্দী ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলী মিলে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের সময় সব জায়গায় পূর্ববাংলার পরিবর্তে পূর্বপাকিস্তান সন্নিবেশিত করা হলে বঙ্গবন্ধু এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পার্লামেন্টে দাড়িয়ে বলেছিলেন, মাননীয় স্পিকার, বাংলা কোথায়? শুরু রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং বে অব বেঙ্গল এই দুটি ছাড়া আর কোথাও বাংলা থাকছে না। ‘বঙ্গবন্ধু তাঁর অভিষ্ট লক্ষ্যে দৃঢ়চেতা ছিলেন বলেই আমরা এই বাংলাদেশ পেয়েছি।

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব মোকতাদির চৌধুরী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ঘোরতরভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ছিলেন। যারা সারাক্ষণ বঙ্গবন্ধুর কথা বলেন, অথচ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন, আমি অবাক হয়ে যায়- তারা কী বঙ্গবন্ধুকে সত্যিই ভালোবাসেন? বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়েন, সেখানে তিনি ঘোরতরভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করেছেন। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলাম, জীবন বাজি রেখে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম, কে আমাদের ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উদ্ভুদ্ধ করেছিল? বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীরা।

তিনি বলেন, আমরা সেদিন যুদ্ধে গিয়েছিলাম, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’-এই সঙ্গীতকে আমার জীবনে ও আমার রাষ্ট্রের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা জন্য। আজকে যে লাল-সবুজের পতাকা উঠে, সেটাতে একসময় বাংলাদেশের মানচিত্র ছিলো- সেই জাতীয় পতাকাকে সমুন্নত করে বিশ্বের বুকে তুলে ধরার জন্য সেদিন আমরা যুদ্ধে গিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের আপোসকামিতা, আমাদের চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবের কারণে এই দেশে কিছু লোক জাতীয় সঙ্গীত গায়তে চায় না, এই দেশে কিছু লোক জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে চায় না, এই দেশে কিছু লোক জাতির পিতাকে কখনো জাতির পিতা হিসেবে গ্রহণ করতে চায় না। যতরকমে কুযুক্তি-কুমন্ত্রণা আছে, সবই তারা করে; প্রয়োজনবোধে পবিত্র ধর্ম ইসলামের নামও তারা ব্যবহার করে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলাপ্রশাসক শাহগীর আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- পুলিশ সুপার অনিসুর রহমান, সিভিল সার্জন ইকরাম উল্যাহ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিকেলে চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কলেজে পৃথক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন মোকতাদির চৌধুরী এমপি। সেখানে তিনি প্রতিবন্ধীদের মাঝে হুইলচেয়ার এবং দুস্থ মহিলাদের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ করেন।

এসময় তিনি জাতির পিতার রুহের মাগফেরাত কামনা এবং তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে উপস্থিত সকলের নিকট দোয়া চান।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে দুস্থ মহিলাদের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ করছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। ছবি : মত ও পথ

শেয়ার করুন