ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ‘সংস্কারে’ আর্ন্তজাতিক অঙ্গন ‘আশাবাদী’?

হাসান শান্তনু

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘অপপ্রয়োগ রোধে তা সংস্কার’ করতে সরকার কতোটা আন্তরিক, এ বিষয়ে সন্দেহ আছে সাংবাদিকদের মধ্যে। তবে আইনটির সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, এতে আর্ন্তজাতিক অঙ্গন ‘আশাবাদী’। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ইতোমধ্যে সংস্কারসহ আইনটিকে ‘আর্ন্তজাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার’ উদ্যোগের কথা তুলে ধরেছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধে কী করা প্রয়োজন, অন্যান্য দেশে ভার্চ্যুয়াল অপরাধ দমনে কোন ধরনের আইন আছে- এ ব্যাপারে সরকারের প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুইদফা আলোচনা করেন। এর আগে দেশে আইন মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ছয় সদস্যের দল গঠিত হয়।

আইনটি প্রয়োগের কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে কী না- তা খুঁজে বের করতে ওই দল জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের (ইউএনএইচসিআর) কার্যালয়ে কাজ করছে। দলটি মানবাধিকার লঙ্গনের কিছু খুঁজে পেলে আইন সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে গত জানুয়ারি মাসে গণমাধ্যমকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান।

মানবাধিকার লঙ্গনের অভিযোগে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য ইভান স্তেফানিৎস ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি জোসেফ বোরেলকে চিঠি দেন। র‌্যাব, এর সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর এ বছরের জানুয়ারিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে একই রকমের ব্যবস্থা চেয়ে ইভান ওই চিঠি লেখেন। এ প্রসঙ্গে বোরেলের উত্তরে দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংস্কার প্রসঙ্গ এসেছে।

বোরেল বলেন, ‘ডিজিটাল মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ)। এ আইনকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার যে ইঙ্গিত বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে, তাকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন তারা।’

স্তেফানিৎসকে আশ্বস্ত করে জোসেফ বোরেল বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব দিকের পাশাপাশি মানবাধিকার বিষয়ে তাদের উদ্বেগ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মধ্যে রয়েছেন তারা। আসন্ন ইউ-বাংলাদেশ জয়েন্ট কমিশন এবং সাবগ্রুপ অন গুড গভার্নেন্স অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এসব বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হবে।’

গত ১৭ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত ওয়েবিনারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সামাজিক মাধ্যমে অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত, মিথ্যা, গুজব ও অপপ্রচার চালানো হয়। কারা এসব গুজব ছড়ায় তার তথ্যও কিছু ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। তাই এসব রোধে ডিজিটাল আইনের দরকার রয়েছে। তবে কোনো আইন চিরন্তন নয়। এই আইনের যেসব ধারার অপপ্রয়োগ হচ্ছে, সেসব বিবেচনা করা যেতে পারে।’

২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ডিজিটাল আইনে করা মোট ৮৩৫টি মামলার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছে ‘সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ’ (সিজিএস)। এসব মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন দুই হাজার ২২ জন। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৭০৭ জন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যায় রয়েছেন রাজনীতিবিদরা, এরপর সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা।

ডিজিটাল আইনে করা মামলাগুলো বিশ্লেষণ করেছেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। এতে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে এই সময়ে ৯৫টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা করেছেন ৮২টি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করেছে ১৩টি। মন্ত্রীদের মানহানির জন্য ৫০টি মামলা করা হয়েছে। যার মধ্যে মাত্র চারটি করেছেন ভুক্তভোগীরা, বাকিগুলো করেছেন দলীয় সমর্থকরা।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংস্কারের দাবি সম্পাদক পরিষদ শুরু থেকেই জানিয়ে আসছে। এ দাবিতে ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সম্পাদক পরিষদের উদ্যোগে নজিরবিহীন মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। এতে দেশের জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকরা সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধনী আনার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান। পরিষদের সাত দফা দাবির মধ্যে ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা সংশোধন।

শেয়ার করুন