ঢাকার রাজারবাগ দরবার শরিফের পরিচালক, কথিত পীর দিল্লুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাম পরিবর্তনের! বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রীয় নীতি, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে ওই জেলাকে তিনি ও তার অনুসারীরা ‘আমানবাড়িয়া’ বলেন। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া নয়, কথিত ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দ যুক্ত এমন ছয়টি জেলার নাম তারা নিজেদের মতো করে বদলে ফেলেছেন। তাদের করা নামকরণে জেলাগুলোর নাম না বললে ‘কোনো মুসলমানের ঈমান থাকবে না’ বলেও ফতোয়া দেন ওই পীর।
পীরের প্রকাশিত দৈনিক আল ইহসান ও মাসিক আল বাইয়্যিনাত নামের দুটি পত্রিকায় জেলাগুলোর নাম লেখা হয় তার নামকরণ অনুসারেই। এ বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াতে ও তাদের মগজধোলাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয় পত্রিকা দুটিকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সিদ্ধান্ত ছাড়া জেলা-উপজেলার নাম বদলানোর ক্ষমতা কারো নেই। বিদ্যমান আইন অমান্য করে পীর ও তার অনুসারীরা জেলাগুলোর ভিন্ন নাম লিখে আসছেন।
রাজারবাগ দরবার নরসিংদীকে নূরসিবাদ বা নূরানীবাদ, নারায়ণগঞ্জকে নূরানীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে আমানবাড়িয়া, ময়মনসিংহকে মুমিনশাহী, ঠাকুরগাঁওকে নূরগাঁও, লক্ষ্মীপুরকে নূরপূর ও গোপালগঞ্জকে গোলাপগঞ্জ করার পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে। যা সম্প্রতি পুলিশের ‘কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের’ (সিটিটিসি) প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে। কথিত পীর দিল্লুরের মুরিদ ও একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জেলার নাম গোলাপগঞ্জ লিখে কার্ডও ছাপিয়েছেন বলে জানতে পারে সিটিটিসি।
রাজারবাগের পীর ও তার দরবারের সব সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান ও তাদের কর্মকাণ্ডে জঙ্গি সম্পৃক্ততা আছে কী না, তা তদন্ত করতে উচ্চ আদালতের দেওয়া আদেশ গত ডিসেম্বর মাসে বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এর মধ্যেও পীরের আলোচিত দুটি পত্রিকা আল বাইয়্যিনাত ও আল ইহসান নানাভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটাচ্ছে।
এসব কার্যক্রম সরাসরি সরকারি নীতিমালা, দেশের প্রচলিত আইন, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিবিরোধী। গত ২১ মার্চ পর্দা মানতে ছবি ছাড়া পরিচয়পত্র দিতে সরকারের কাছে দাবি জানায় রাজারবাগ দরবারের মহিলা আনজুমান শাখা।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, ‘মৌলবাদী প্রবণতা থেকেই ধর্মীয় সংগঠনগুলো সাম্প্রদায়িক শব্দ ব্যবহার করছে। কোনো গোষ্ঠী নিজেদের মতো করে একটা শব্দ, নাম চাপিয়ে দিতে পারে না।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম পরিবর্তনের তথাকথিত দাবি ধর্মীয় উগ্রপন্থি বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছে। অযৌক্তিক এ দাবির পক্ষে ‘জনমত’ তৈরিতে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণাও চালিয়ে আসছে সংগঠনগুলো।
এসব প্রচারণার সঙ্গে ওই জেলার স্থানীয় কতিপয় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ হেফাজত, প্রয়াত ফজলুল হক আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট, চরমোনাইয়ের কথিত পীরের দলের নেতাকর্মীরা জড়িত। একই ধর্মের নামে সংগঠনগুলো রাজনীতি করলেও ধর্মীয় মতবাদ নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ প্রকাশ্য। তবে মৌলবাদের প্রশ্নে সংগঠনগুলোর মতবাদ হয়ে ওঠে এক ও অভিন্ন।
আওয়ামী লীগের সরকারের (১৯৯৬-২০০১) আমলের শেষদিকে আদালতের দেওয়া ফতোয়াবিরোধী রায়ের বিরোধিতা করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভয়াবহ সহিংসতায় জড়ান ফজলুল হক আমিনীর দলের নেতাকর্মীরা। এতে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন মারা যান। একে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের ওই সময়ের আমির ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ‘শহীদবাড়িয়া’ হিসেবে নামকরণের ঘোষণা দেন। এরপর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ‘শহীদবাড়িয়া’ করার দাবি জানিয়ে আসছেন ইসলামী ঐক্যজোটের নেতাকর্মীরা।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জেলা শহরের কয়েকটি দোকান-পাট, হোটেল-রেস্তোরাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থলে ‘শহীদবাড়িয়া’ লেখা হয়। আমিনীর মৃত্যুর পর তার দলের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে। বিভিন্ন বিতর্কের কারণে দলটির সাংগঠনিক তৎপরতা কমে যায়। ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম বদল করে ‘শহীদবাড়িয়া’র দাবিও স্থিমিত হয়ে পড়ে।
তবে চরমোনাইয়ের পীরের দল সরব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হিজাব-নিকাব পরার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয় দাবি করে ক্যাম্পাসে ‘হিজাব-নিকাব পরার স্বাধীনতা’ নিশ্চিত করার দাবি গত বৃহস্পতিবার জানায় ইসলামী আন্দোলন ও চরমোনাই পীরের দলের ছাত্র সংগঠন। ‘প্রোটেস্ট সেল অ্যাগেইনস্ট হিজাবোফোবিয়া ইন ডিইউ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্মের ব্যানারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্বে আছেন ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি জামালুদ্দীন মুহাম্মদ খালিদ।
মৌলবাদীদের দাবির মুখে দেশের কোনো জেলা, উপজেলার নাম বদলানোর তথ্য নেই। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভায় পাঁচটি জেলার ইংরেজি বানান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বরিশাল, যশোর ও বগুড়া- এ পাঁচ জেলার ইংরেজি নামের বানান সংশোধিত হয়।
এর আগে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলে ঢাকার ইংরেজি বানান সংশোধিত হয়। তবে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তথাকথিত হিন্দুয়ানি শব্দের নামের গ্রামের নাম বদল করে ‘ইসলামি’ শব্দে নামকরণ করা হয়।