ভেতর থেকে ‘ষড়যন্ত্রের’ কবলে বিএনপি!

হাসান শান্তনু

বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক নেতার নানামুখি তৎপরতা দলের ভেতর দুশ্চিন্তার জন্ম দিয়েছে। ভেতর থেকে দলটি আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে ‘ভাঙনের’ কবলে পড়ে কী না, এ আশঙ্কা করছে শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের দুজন ভাইস-চেয়ারম্যানসহ কয়েক নেতার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আবারো নড়চড়।

পরবর্তী নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে ‘বৃহত্তর জোট’ গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার আগে ‘অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র’ সামলানোর চাপে পড়েছে দলটি।

universel cardiac hospital

বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, দলটির বলয়ের বাইরে এসে জাতীয়তাবাদী ঘরানার নতুন জোটের কথা ভাবছে জোটের শরিক কয়েকটি দল। দলকে ‘ভাঙা ও জাতীয়তাবাদী শক্তির মধ্যে বিভাজন’ বাড়াতে অনেকদিন ধরে একটি মহল ‘সক্রিয়’। আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ওই মহল আবারো তৎপর। এতে দূর থেকে প্রভাবশালী কোনো মহলের ‘ষড়যন্ত্র’ থাকতে পারে।

দীর্ঘদিন থেকে বিএনপির মূল নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে দলে ‘বিভক্তি’ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এতে দলের নানা কারণে ক্ষুব্ধ, হতাশ নেতাদেরকে যুক্ত করার চেষ্টা আছে। তাদেরকে নানা প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। দল, জোটের এমন অন্তত ৪০জন নেতার সঙ্গে বিভিন্ন সময় দেশে-বিদেশে বৈঠক হয় ওই মহলের। ২০১৯ সাল থেকে এ তৎপরতা শুরু হয়। সর্বশেষ গত মাসে দেশের বাইরে এমন বৈঠক হয় বলে দলটির উচ্চপর্যায়ের কাছে তথ্য আছে।

বিএনপির এক ভাইস-চেয়ারম্যান গত রোববার ঢাকায় পেশাজীবী সমাজের ব্যানারে সমাবেশ ডাকেন। এতে আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে চাকরিরত অবস্থায় সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী আলোচিত-সমালোচিত সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর উপস্থিতি দলে বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দেয়।

ওই ভাইস-চেয়ারম্যানের তৎপরতা দলে দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহের তালিকায় থাকায় সমাবেশে যেন কেউ না যান, সে জন্য আগের রাত থেকে তৎপর ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। অনেককে ফোন করে সমাবেশে যেতে নিষেধ করা হয়। কেউ কেউ নিজে থেকেই যাননি। ওই সমাবেশ থেকে ‘সরকার পতনের’ ডাক দেওয়া হয়।

রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ হলে পেশাজীবীরা ‘গণ-অভ্যুত্থানের’ দায়িত্ব নেবেন বলে সমাবেশে দাবি করা হয়। শিগগিরই পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণার কথা জানিয়ে নেতাকর্মীদেরকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানো হয়। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের অজান্তে এ ধরনের কর্মসূচির আয়োজন আর ‘সরকার পতনের’ ডাক দেওয়া নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে মত ও পথকে বলেন, ২০১৯ সালে দেশে বিকল্প জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তি দাঁড় করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই বছর এ বিষয়ে দেশ-বিদেশে গোপন একাধিক বৈঠকের আয়োজন হয়। সেগুলোতে দলটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায়সহ কয়েক নেতা অংশ নেন।

ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে দলের দুই ভাইস-চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমদসহ আরেকজনের যুক্ত থাকার বিষয়ে দলের ভেতরে আলোচনা আছে। এ কারণে গত বছর তাঁদেরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিএনপি। এর নেপথ্য কারণ ছিল ওই সন্দেহ। ওই দুই ভাইস-চেয়ারম্যানের একজন ছিলেন গত রোববারের পেশাজীবী সমাবেশের নেতৃত্বে।

অন্যদিকে আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপি ও সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টির নেতৃত্বে নতুন জোট গঠন ঠেকাতে রাজনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দেয় বিএনপি। তাদের জাতীয় সরকার গঠনের দাবি ‘কৌশলে’ মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি।

পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন, না জাতীয় সরকার—এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ওঠা বিতর্কের রেশ টানতে জাতীয় সরকারের নতুন ধারণা নিয়ে হাজির হতে চাচ্ছে বিএনপি। শরিকদের চাপের মুখে শিগগিরই জাতীয় সরকারের এ ধারণা তুলে ধরে সরকারবিরোধী দলগুলোকে একত্র করার উদ্যোগ নেবে দলটি।

বিএনপির সূত্র বলছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চলতি বছরে দলের নেতৃত্বে বৃহত্তর নতুন ঐক্য গড়ার উদ্যোগ ‘হোঁচট’ খায় জাতীয় সরকার প্রশ্নে। বিএনপির নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবি হলেও জোটের শরিক বেশ কয়েকটি দল চায় জাতীয় সরকার। এতে জোট গঠন প্রক্রিয়া গতি হারায়।

তাই নতুন রাজনৈতিক কৌশলের সিদ্ধান্ত নেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। গত সোমবার বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখার আলোচনা সভায় দেওয়া বক্তব্যে জাতীয় সরকারের বিষয়ে আভাস দেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

বিএনপি বলছে, নির্বাচনের আগে নয়, বিজয়ী হলেই জাতীয় সরকার গড়তে চায় দলটি। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। গত কয়েকদিন ধরে দলটির নেতাকর্মীরা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এ ধারণার প্রচারণা করছেন।

দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জাতীয় সরকার ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন নেতারা। ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে। চলতি সপ্তাহ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হতে পারে। তবে শরিক দলের নেতারা তাদের যুক্তিতে এখনও অনড়।

গত সংসদ নির্বাচনের পর বিভিন্ন সময় দেওয়া বক্তব্যে আবদুর রব, অলি আহমদ, মুহাম্মদ ইবরাহিম ‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন’ আয়োজনের দাবি জানান। এ দাবিতে বিএনপির সঙ্গে এক মঞ্চে তাঁরা আন্দোলন করেন। এখন তাঁদের বক্তব্য ভিন্ন। বিএনপির সঙ্গে তাঁদের মতের অমিল।

তাঁরা বলছেন, জাতীয় সরকার গঠনের কথা। তাঁদের নেতৃত্বে সম্ভাব্য জোটের বিশেষ দাবি হবে জাতীয় সরকার গঠনের। নাগরিক ঐক্য ‘জাতীয় সরকারের’ কথা না বললেও ‘দীর্ঘ মেয়াদের নির্বাচনকালীন সরকারের’ দাবি জানাচ্ছে।

শেয়ার করুন