‘আমি হেঁটে কলেজের দিকে যাচ্ছিলাম, হুট করে পাশ থেকে মধ্যবয়সী, লম্বা দাড়িওয়ালা একজন “টিপ পরছোস কেন” বলেই বাজে গালি দিলেন। তাকিয়ে দেখলাম তাঁর গায়ে পুলিশের পোশাক। একটি মোটরবাইকের ওপর বসে আছেন। প্রথম থেকে শুরু করে তিনি যে গালি দিয়েছেন, তা মুখে আনা এমনকি স্বামীর সঙ্গে বলতে গেলেও লজ্জা লাগবে। ঘুরে ওই ব্যক্তির মোটরবাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তখনো তিনি গালি দিচ্ছেন। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। একসময় আমার পায়ের পাতার ওপর দিয়েই বাইক চালিয়ে চলে যান।’
এভাবে ঢাকার রাস্তায় হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার। শনিবার সকালের এ ঘটনা নিয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তিনি।
সন্ধ্যায় মুঠোফোনে ঘটনার বিস্তারিত জানিয়েছেন লতা সমাদ্দার। হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এর আগেও রাস্তাঘাটে বিভিন্ন সময় বাজে কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু পুলিশের পোশাক গায়ে এক ব্যক্তি যখন এ ধরনের আচরণ করলেন, তা সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না।
লতা সমাদ্দার জানান, শনিবার সকাল ৮টা ২০ মিনিট থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে ফার্মগেট মোড় পার হয়ে তেজগাঁও কলেজের দিকে যাওয়ার সময় ঘটনাটি ঘটে। সেজান পয়েন্টের সামনে বন্ধ করে রাখা মোটরবাইকের ওপর বসে কথাগুলো বলেন ওই পুলিশ সদস্য। তিনি থানায় যে অভিযোগ করেছেন, তাতে পুলিশের পোশাক পরা ওই ব্যক্তি যে গালি দিয়েছেন তা লেখার যোগ্য নয় বলে উল্লেখ করেছেন।
লতা সমাদ্দার বলেন, ‘আমি পেছন ফিরে গিয়ে তাঁর আচরণের প্রতিবাদ করায় আরও গালিগালাজ করেন। তবে ওই ব্যক্তির নাম বা পদবি খেয়াল করার কথা মাথায় ছিল না। কথা বলার একপর্যায়ে বলতে গেলে আমার গায়ের ওপর দিয়ে বাইক চালিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি বাধ্য হই পিছিয়ে যেতে। তবু আমার পায়ে আঘাত লাগে। বাইকটি চালানোর পর বাইকের নম্বর যতটুকু মনে আছে (মোটরবাইক নম্বর–১৩৩৯৭০), তা পুলিশকে দিয়েছি।’
ঘটনার পর রাস্তার ঠিক বিপরীত পাশে কর্তব্যরত তিনজন ট্রাফিক পুলিশের কাছে গিয়ে লতা সমাদ্দার ঘটনাটি বর্ণনা করেন। এই তিনজনের মধ্যে একজনের নাম অভিজিৎ। তাঁরাই থানায় অভিযোগ করতে পরামর্শ দেন।
লতা বলেন, আশপাশের কয়েকজন লোক একটু দূর থেকে ঘটনাটি দেখছিলেন। তবে কেউ এগিয়ে আসেননি। হয়তো ভেবেছেন পুলিশের পোশাক পরা লোক, তাই ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই।
এই শিক্ষিকা বলেন, ‘ঘটনার পর আমি আমার স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক মলয় বালাকে ফোন দিই। আমার সহকর্মীরাও আসেন। এরপর থানায় অভিযোগ করি। আমি চাই ওই ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। আর আমি কপালে টিপ পরব কি না, তা বলার তিনি কে? আমার মনে হয়েছে ঘটনাটার প্রতিবাদ হওয়া দরকার। এ ধরনের মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক মানুষের হাত থেকে নারীরা নিরাপদে থাকুক।’
ঘটনাটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না লতা সমাদ্দার। কলেজে নিজের বিভাগে পৌঁছে হাউমাউ কেঁদেছেন। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে এই যদি অবস্থা হয়, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ভাবতে হচ্ছে কোথায় আছি আমরা। আমি হিন্দু, টিপ পরা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। শুধু আমি কেন যে কেউ চাইলে টিপ পরতে পারেন। এর আগেও হাতের শাঁখা নিয়ে দু-একজন বাজে মন্তব্য করেছেন, তবে তা তেমন গায়ে মাখিনি। তবে আগের মন্তব্যকারী সাধারণ মানুষ এবং আজকে পুলিশের পোশাক গায়ে দেওয়া ব্যক্তির বয়ান কিন্তু প্রায় একই বা কাছাকাছি।’