এখন সন্ত্রাস বাড়লে দায় কে নেবে? : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

এ কে আবদুল মোমেন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। ফাইল ছবি

র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি গতকাল মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) রাতে ওয়াশিংটন ডিসিতে নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিসে (ইউএসআইপি) আলোচনায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সন্ত্রাস, জিহাদের উত্থানের মুখে র‌্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য র‌্যাব প্রতিষ্ঠায় পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। র‌্যাবের কারণেই বাংলাদেশে সন্ত্রাস, উগ্রবাদ, মানবপাচার, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর তরুণরা এখন র‌্যাবে আসতে চাচ্ছে না। বাংলাদেশে এখন সন্ত্রাস, মাদক চোরাচালান বাড়লে এর দায় কে নেবে?

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত তেরেসিতা শেফার আলোচনা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নিষেধাজ্ঞার যৌক্তিকতা নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন। মোমেন আরো বলেন, র‌্যাব জনগণের আস্থা অর্জন করেছে। কারণ তারা দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৭৬ জন গুম বা নিখোঁজ হয়েছে। ইরাকে ১৬ হাজার ৮০০ জন গুম হয়েছে। তাদের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। শ্রীলঙ্কায় প্রায় সাত হাজার লোক গুম হয়েছে। তাদের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি।

universel cardiac hospital

এ সময় সাবেক রাষ্ট্রদূত তেরেসিতা শেফার বলেন, ইরাকের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। এর প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আপনি আর্জেন্টিনা, আলজেরিয়ার দিকে দেখুন। সেখানেও চার-পাঁচ হাজার গুমের অভিযোগ আছে। যা হোক, এটি যুক্তরাষ্ট্রের বিচার-বিবেচনার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনা করলে আমরা খুশি হব।’

ইউএসআইপি প্রেসিডেন্ট লিসে গ্র্যান্ডে বলেন, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা দেশটির জনগণের প্রচেষ্টা ও লক্ষ্যের প্রতিফলন। সাবেক রাষ্ট্রদূত তেরেসিতা শেফার আরো বলেন, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ৫০ বছর নির্বিঘ্ন ছিল না। বিশেষ করে শুরুটা ছিল বেশ ঝাঁকুনিপূর্ণ। অতি সম্প্রতি এই যাত্রা নির্বিঘ্ন হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত জোরালো। তবে আমরা চীনের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে থাকি। ভারত ও চীন নিয়ে আমাদের কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই।’

জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বেশ কিছু পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ উপকূলীয় এলাকা ডুবে যাবে। এর ফলে তিন থেকে চার কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কভিড মহামারি সত্ত্বেও গত বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৯৪ শতাংশ। এটি বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ। ১২ বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে।

এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ করতে পারে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক লক্ষ্য অবাধ, উন্মুক্ত, অংশগ্রহণমূলক এবং চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখতে পারে।

ভিন্নমতাবলম্বীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কী করছে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে কাজ চলছে। মন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুর্বলতা কাটাতে সরকার কাজ করছে। তবে এই আইনের প্রয়োজন আছে।

ব্লিংকেন-মোমেন বৈঠকে মানবাধিকার, আইনের শাসনে জোর

নিরাপদ ও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি হিসেবে মানবাধিকার, আইনের শাসন ও ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষায় গুরুত্ব তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। গত সোমবার রাতে ওয়াশিংটন ডিসিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস এ তথ্য জানান।

নেড প্রাইস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন বৈঠক করেছেন। তাঁরা এই সম্পর্কের মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, ফুলব্রাইট বিনিময় কর্মসূচির আওতায় মানুষে মানুষে ক্রমবর্ধমান সম্পর্কসহ গত অর্ধ শতাব্দীতে সমন্বয়ের ধরন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁরা জলবায়ু সংকট মোকাবেলা, জেনোসাইডের শিকার রোহিঙ্গাদের প্রয়োজন মেটানো এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে উত্সাহিত করার ক্ষেত্রে চলমান সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। নির্বাচনে বিএনপিকে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনে বিএনপি ছাড়া সব দলই অংশ নিচ্ছে। বিএনপির সৃষ্টি সামরিক বাহিনীর হাতে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ হলো বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসা।

র‌্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে বৈঠকে অনুরোধ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে তিনি পরে সাংবাদিকদের বলেন, র‌্যাব এমন সময় তৈরি হয়েছিল যখন সন্ত্রাস, জিহাদি—এগুলোর উৎপাত খুব বেশি ছিল। এক দিনে ৪৯৫টি বোমাবাজি হয়েছিল সারা দেশে। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। সেখানে ২৪ জন মারা যায়, ৩৭০ জন আহত হয়। সারা দেশে মানুষ আতঙ্কে ছিল।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, র‌্যাবের কেউ হয়তো কখনো বেশি করে ফেলেছে। কিন্তু তাদের জবাবদিহির নিজস্ব ব্যবস্থা আছে। তাদের অনেকের শাস্তি হয়েছে। এমনকি ফাঁসিও হয়েছে ১২ জনের। সুতরাং তাদের জবাবদিহি আছে।

মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, ‘আপনাদের রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি বলেছিলেন, র‌্যাব বাংলাদেশের এফবিআই। সেই ইনস্টিটিউশনে আপনারা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় তরুণরা চাকরি করতে নিরুত্সাহিত হবে। তাই আমরা চাই, আপনারা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারেরও প্রক্রিয়া আছে। তবে এ ক্ষেত্রে জবাবদিহি প্রয়োজন। জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বললাম, অবশ্যই। আমরা সব ধরনের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

বৈঠকে আলোচনা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার পর গত চার মাসে র‌্যাবের হাতে কেউ মারা যায়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও গত চার মাসে বাংলাদেশের রেকর্ড খুব ভালো। একজন লোকও গ্রেপ্তার হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ঘাতক রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত চেয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনে এটি ‘গেম চেঞ্জার’ হতে পারে। একজন খুনি যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পেয়েছে, এটি আমেরিকানরাও পছন্দ করবে না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিউ ইয়র্কে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট চালুর প্রক্রিয়া তরান্বিত করার অনুরোধ জানিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর নিপীড়নকে ‘জেনোসাইড’ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রশংসা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে মিয়ানমারের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) এখনো বহাল থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মিয়ানমারের ওপর আরো নিষেধাজ্ঞা দিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রম ইস্যুতে বাংলাদেশের অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি এ দেশে যুক্তরাষ্ট্রের আরো বিনিয়োগ প্রত্যাশা করেন। ব্যবসা সহজীকরণ ও মামলাজট কমাতে ফরেনসিক ল্যাব চালু করতেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চান। যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত সোমবার সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) প্রশাসক সামান্থা পাওয়ারের সঙ্গেও বৈঠক করেন। বৈঠকে শ্রম পরিস্থিতি, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

সামান্থা পাওয়ার বাংলাদেশে আরো কভিড টিকা পাঠানোর প্রস্তাব দেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে ধন্যবাদ জানান। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ছয় কোটি ১০ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়েছে।

শেয়ার করুন