বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্যা ও আমাদের করণীয়

অধ্যাপক ডা. অ ফ ম রুহুল হক এমপি

স্বাস্থ্য খাত
স্বাস্থ্য খাত। প্রতীকী ছবি

স্বাস্থ্য খাত একটি রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। বলা হয়ে থাকে, যে দেশের জনগণ স্বাস্থ্যের দিক থেকে এগিয়ে, সে দেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে গতিশীল।

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই তাই বঙ্গবন্ধু এ খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ণাঙ্গ দেশ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি বিষয়ে সময়োপযোগী ও বিজ্ঞানসম্মত দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন।

দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সুদূরপ্রসারী রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশের সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সুনিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধুর মৌলিক চিন্তা ছিল দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের গ্রামীণ জনগণের জন্য মানসম্মত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা।

সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেছিলেন জাতির এ মহান নেতা। স্বাস্থ্য খাতকে শুধু গুরুত্ব দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, ব্যাপক সময়োপযোগী পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে গৃহীত ১০ শয্যার থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বিশ্বে আজও সমাদৃত মডেল। বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার রূপরেখা অনুসরণ করেই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সূচনা হয়। সে চিন্তাধারাকে পরবর্তী সময়ে ধারণ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে উন্নয়ন হয়েছে, তা একটি মাইলফলক। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে অবকাঠামো গড়ে উঠেছে তা প্রশংসনীয়। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মৌলিক স্বাস্থ্য সুবিধাগুলো নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সঙ্গত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য কাঠামোর বিস্তৃত নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবকাঠামো গ্রামীণ পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও রাজধানীকে কেন্দ্র করে তিনটি স্তরে গড়ে উঠেছে। সর্বনিু স্তরে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। মাধ্যমিক স্তরে রয়েছে মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র, জেলা হাসপাতাল এবং তৃতীয় স্তরে রয়েছে মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল ও অতি বিশেষায়িত হাসপাতাল।

কিন্তু এত অগ্রগতির পরেও কিছু সমস্যার কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ফলাফল মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। উপজেলা হাসপাতালে পদ থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ পদ খালি থাকে। স্থানীয়ভাবে শূন্যপদগুলোতে সঙ্গে সঙ্গে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব, অনেক দেশেই এ ব্যবস্থা আছে। হাসপাতালের ভর্তি রোগীরা প্রায় সব ওষুধ বিনা পয়সায় পেয়ে থাকে, কিন্তু বহিঃবিভাগ রোগীদের জন্য ওষুধ বরাদ্দ নেই বললেই চলে। এ ছাড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিষেশায়িত হাসপাতালে অনেক বেশি রোগীর ভিড় থাকায় রোগীদের মানসম্মত চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ উপজেলা হাসপাতালে রোগীরা ডাক্তার পায় না, ঠিকমতো ওষুধ পায় না, ফলে তারা জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে আসতে বাধ্য হয়। একসঙ্গে অনেক রোগীর ভিড় থাকায় এসব হাসপাতাল মানসম্মত চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলো চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত করতে পারলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগীর মানসম্মত চিকিৎসা জেলা/উপজেলা হাসপাতালে দেওয়া সম্ভব। এজন্য উপজেলা, ইউনিয়ন এবং কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে রোগীর সেবার মানের মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থনৈতিক সুব্যবস্থাপনা দ্বারা দেশ এগিয়ে চলেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেড়েছে, কৃষিতে উন্নয়ন সাধন হয়েছে, শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে, সর্বস্তরে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে, সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হলেও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারছে না। তাই স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে জনগণের অভিযোগ থেকেই যাচ্ছে। তাহলে এখন করণীয় কী? প্রয়োজন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানসম্মত পুনর্গঠন।

আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় পদ সৃষ্টি করা হলেও সে অনুযায়ী জনবল নেই, এক হাজার ৫৮১ জন লোকের জন্য রয়েছেন একজন নিবন্ধিত চিকিৎসক। গ্রামীণ, প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলগুলোতে চিকিৎসক শূন্যতার হার বেশি। অভাব রয়েছে প্রশিক্ষিত নার্সের। অনেক সরকারি হাসপাতালে সরঞ্জাম পাওয়া গেলেও প্রযুক্তিবিদের পদ খালি রয়েছে। জনবল (ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকস, ল্যাব-টেকনিশিয়ান) নিয়োগের ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণ না করা হলে এ অব্যবস্থাপনার সমাধান হবে না। বিকেন্দ্রীকরণের ধাপ নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করে নির্ধারিত করতে হবে। শুধু চিকিৎসক নিয়োগ দিলে হবে না, কর্মস্থলে তাদের ধরে রাখাও জরুরি। শুধু উচ্চ বেতনই চিকিৎসকদের কর্মস্থলে থাকার ব্যাপারে আকৃষ্ট করতে পারে না, তাদের নিরাপত্তার দিকেও নজর দিতে হবে। বিশেষ করে নারী চিকিৎসকদের আবাসিক ও কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন। এমনও অনেক ঘটনা আছে, যেখানে আধুনিক স্বাস্থ্য সরঞ্জাম থাকলেও সেগুলো চালানোর মতো কাউকে পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে এগুলো পরিচালনার অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং রোগীরা অবহেলায় মারা যায়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে প্রতিরোধী স্বাস্থ্যসেবা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে প্রতিরোধী স্বাস্থ্যসেবা একেবারেই গড়ে ওঠেনি। তাই চিকিৎসা-শিক্ষা ব্যবস্থাকে চার ভাগে বিন্যাস করতে হবে। যেমন-ক্লিনিসিয়ান, শিক্ষক, প্রশাসন ও রোগ প্রতিরোধক। এ চার ভাগের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে একজন শিক্ষার্থী তার ভবিষ্যৎ কার্যপরিধি নির্ধারণ করবে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ চিকিৎসকের রোগী দেখা নিয়ে দেশের মানুষ সন্তুষ্ট নয়। তারা মনে করে, চিকিৎসকরা আন্তরিকভাবে রোগী দেখেন না। অন্যদিকে চিকিৎসকরা মনে করে, লোকজন তাদের ঠিকভাবে মূল্যায়ন করে না। রোগীর চিকিৎসা একইসঙ্গে শুদ্ধবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের যৌথ প্রয়োগ। মেডিকেল সায়েন্স হচ্ছে শুদ্ধবিজ্ঞান। কিন্তু যে মানুষটিকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে সে এবং তার স্বজনদের সঙ্গে ব্যবহারের বিষয়টি সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্গত। আমাদের মেডিকেল শিক্ষা পাঠ্যক্রম এবং প্রশিক্ষণে সমাজমনস্কতা ও সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে হবে। রোগ নির্ণয়ে দীর্ঘসূত্রতা বেশিরভাগ সময় রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ সমস্যা সমাধানে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয়ে রোগীরা উপজেলা ও জেলাভিত্তিক ইনডোর স্বাস্থ্যসেবা পেতে ডিজিটাল সুপারিশ পদ্ধতি চালু করতে হবে এবং অপেক্ষাকৃত জটিল রোগের জন্য উপজেলা থেকেই জেলা, বিভাগীয় ও বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে সুপারিশ পদ্ধতির মাধ্যমে রোগী পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয় ব্যবস্থাপনা ও মেরামতের জন্য রোগীদের সেবা ব্যাহত হয়। এ ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনা করতে হলে মেরামতের ব্যবস্থার জন্য অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান ও ইঞ্জিনিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ করে দ্রুত সময়ে সব যন্ত্রপাতি মেরামত করতে হবে এবং এ ব্যবস্থাকে মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। এর জন্য বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা হাসপাতালের পরিবেশ উন্নতির জন্য অপরিহার্য। রোগী এবং রোগীদের সঙ্গে আত্মীয়স্বজনের কথা চিন্তা করে সে অনুযায়ী টয়লেট ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ ও তদারকির জন্য জনবল জরুরি। হাসপাতালের সেবা সম্পর্কে তথ্য প্রদান এবং তত্ত্বাবধানের জন্য মানবিক জ্ঞানসম্পন্ন জনবল নিয়োগ দিতে হবে। এরা রোগীদের সঙ্গে ‘পাবলিক রিলেশনের’ ভূমিকা পালন করবে।

গত ৫০ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বিরুদ্ধে সব থেকে বড় অভিযোগ হচ্ছে ‘অব্যবস্থাপনা’। সত্যিকার অর্থেই দেশে পেশাদার একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। তৃণমূল থেকে যত ওপরে যাওয়া যায় সর্বত্রই একই দৃশ্য প্রতীয়মান হয়। আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হচ্ছে, জিডিপির পাঁচ শতাংশের মতো অর্থ স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া। বাংলাদেশে এক যুগের অধিককাল ধরে বাজেটে জিডিপির এক শতাংশের কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থেরও কম-বেশি ৭০ শতাংশ বেতন-ভাতা ইত্যাদির মতো খাতে খরচ হয়। বাকি অর্থ স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে ব্যবহৃত হওয়ার কথা, যা নিতান্তই অপ্রতুল। স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক উন্নয়নের কথা ভেবে এ খাতের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতিমুক্ত রেখে এ অর্থের সর্বোচ্চ সুষ্ঠু ব্যবহার করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন নিয়মিত গবেষণা, সঠিক কর্মপরিকল্পনা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে বর্তমানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অর্জনগুলো বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেশের জনসাধারণের সামগ্রিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটিগুলো নিরসন করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে তা বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।

অধ্যাপক ডা. অ ফ ম রুহুল হক এমপি : সাবেক মন্ত্রী; সভাপতি-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ

শেয়ার করুন