‘যারা মাদক নিবারণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারা চায় মাদক বেশি ব্যবহার হোক’

মোহাম্মদ সজিবুল হুদা

তামাক পণ্য ব্যবহারের কারণে শুধু স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, একই সঙ্গে অনেক ধরনের সামাজিক সম্ভাবনাগুলোরও ক্ষতি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গঠনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে তামাক পণ্যের সহজলভ্যতা কমাতে আরও কার্যকর করারোপ করতে হবে। একইসঙ্গে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে আরও জনকল্যাণমূলক করতে হবে।’

সোমবার (২৩ মে) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা- উন্নয়ন সমন্বয়ের আয়োজনে ‘তামাক পণ্যে কার্যকর করারোপ বিষয়ক প্রাক-বাজেট আলোচনা’য় বক্তারা এসব কথা বলেন। আলোচনায় অংশ নেন সংসদ সদস্য, বিষয় বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মীরা।

অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি (ব্রাক্ষণবাড়িয়া-৩), সংসদ সদস্য মো. মনোয়ার হোসেন চৌধুরী (গাইবান্ধা ৪), সংসদ সদস্য উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগম (মহিলা আসন ১২), সংসদ সদস্য শামীমা আক্তার খানম (মহিলা আসন-২১), সংসদ সদস্য হাবিবা রহমান খান (মহিলা আসন-১৭), সংসদ সদস্য বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেন (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১)।

প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী (বিভাগীয় প্রধান, দন্ত চিকিৎসা বিভাগ, বারডেম), ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম (গবেষণা পরিচালক, সিপিডি), ড. তৈয়বুর রহমান (স্কুল অব লিবারেল আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্স, আইইউবি), মো. মোস্তাফিজুর রহমান (লিড পলিসি অ্যাডভাইজার, সিটিএফকে, বাংলাদেশ), ড. তানিয়া হক (প্রফেসর, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া তামাক ব্যবহারের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে; বিস্ময় প্রকাশ করে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি বলেন, যারা মাদক নিবারণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারা চায় মাদক বেশি ব্যবহার হোক। সুতরাং মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য যত বেশি আপনি মাদক নিবারণ সংশ্লিষ্ট লোকদের নিয়োগ দিবেন, তত বেশি মাদক আপনার দেশে ঢুকবে। এরসাথে যারা যুক্ত আছে, তাদের মধ্যে রাজনীতিবিদেরাও আছেন; তারা বিভিন্নভাবে এটিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এখন সিসা বার, হুক্কা এসব নিয়ে বার হচ্ছে। এসবও ট্যাক্সের আওতায় আনতে হবে।

বর্তমানে সিগারেট ব্যবহার কিছুটা কমলেও মাদক বেশি ব্যবহার হচ্ছে বলে জানান তিনি।

মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে ধর্মীয় শিক্ষার সাথে জড়িত ব্যক্তিরাও যে নমনীয় এই বিষয়টি বুঝাতে গিয়ে এসময় তিনি তাঁর একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি আমার বিরুদ্ধে যারা বক্তব্য দিয়েছে (কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক), অনেক বছর আগে তাদের নিয়ন্ত্রণ একটি মাদ্রাসায় আমি গিয়েছিলাম; যাওয়ার পর তারা আমাকে বলেন- স্যার আমাদের মাদ্রাসার পিছনে একটা জায়গা আছে, এখানে মাদক বেচা-কেনা হয়। আমি তখন তাদেরকে বললাম তাহলে কী করা যায় এখন? তখন তারা বললেন, এটি নিরসন করা দরকার। আমি সেদিন তাদের বলেছিলাম, কয় দিন আগে আপনাদেরকে দেখলাম লাঠিসোঁটা নিয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী লেখা যেসমস্ত গেইট ছিল সবগুলো ভেঙে দিলেন, অথচ আপনাদের মাদ্রাসার পিছনে মাদক ব্যবসার এতো একটা স্থান থাকার পরও আপনারা এইটার বিরুদ্ধে মিছিল করেন না কেন? তখন সবাই নিশ্চুপ; কেউ কোনো কথা বলেনি, কারণ ঐসব মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের অর্থকড়ির সম্পর্ক আছে। কেননা যারা মাদকের ব্যবসা করে তারা বেহেশতে যাওয়ার জন্য মাদ্রাসাতে টাকা দেয়।

‘পুরুষরা এখন ঘরে লুকিয়ে কিংবা বাথরুমে সিগারেট খান’

বারডেমের ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি বিভাগের উপদেষ্টা ডা. অরুপ রতন চৌধুরী বলেন, ‘পুরুষরা এখন ঘরে লুকিয়ে কিংবা বাথরুমে গিয়ে সিগারেট খান। এমনকি এস্ট্রেও তারা আড়ালে রাখেন। এটা আমাদের অনেক বড় অর্জন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত হবে বাংলাদেশ।’

নারীদের ক্ষেত্রে সিগারেট অনেক বেশি ক্ষতিকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে নারীদের স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্যাসিভ স্মোকিং অনেক বড় কারণ। মেয়েদের মধ্যেও সিগারেট খাওয়া একটা প্যাশন হয়ে গেছে। এছাড়া ই-সিগারেটও অনেক বেড়ে গেছে। এটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচার হয়। এর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।

তামাক পণ্যে ট্যাক্স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সিগারেট খুচরা বিক্রি বন্ধ করার দাবি জানিয়ে প্রাক-বাজেট আলোচনায় সংসদ সদস্যরা জানান, সিগারেটের প্যাকেটে যে ট্যাগ লাগানো থাকে খুচরা বিক্রি হলে সেটা সবার নজরে আসে না। এছাড়া খুচরা বিক্রি বন্ধ হলে সিগারেট বিক্রির হারও কমবে।

এসময় তামাক বন্ধ করার জন্য ভ্যাট-ট্যাক্স বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় কার্যকর বিষয় জানিয়ে তামাক পণ্যের সহজলভ্যতা রোধে পরামর্শ দেন আয়োজকরা।

পরামর্শগুলো হলো- বর্তমানে তামাক পণ্যের ঘোষিত খুচরা মূল্যের ওপর যে অ্যাড-ভেলোরেম (অর্থাৎ ঘোষিত খুচরা মূল্যের শতাংশ হিসেবে) সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা আছে। তার পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই সম্পূরক শুল্ক নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি করা।

ফিল্টারবিহীন বিড়ি (২৫ শলাকার প্যাকেট) ও ফিল্টারযুক্ত বিড়ির (২০ শলাকার প্যাকেট) ঘোষিত ন্যূনতম খুচরা মূল্য যথাক্রমে ১৮ টাকা থেকে ২৫ টাকা এবং ১৯ টাকা থেকে ২০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলোর ওপর সম্পূরক শুল্ক হবে যথাক্রমে ১১ দশমিক ২৫ টাকা ও ৯ টাকা।

নিম্ন, মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম- এই চার স্তরের সিগারেটের (১০ শলাকার প্যাকেটের) ঘোষিত ন্যূনতম খুচরা মূল্য যথাক্রমে ৩৯ থেকে ৫০ টাকা, ৬৩ থেকে ৭৫ টাকা, ১০২ থেকে ১২০ টাকা ও ১৩৫ থেকে ১৫০ টাকা করা। প্রস্তাবনা অনুসারে এগুলোর ওপর সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক হবে যথাক্রমে ৩২ দশমিক ৫০ টাকা, ৪৮ দশমিক ৭৫ টাকা, ৭৮ টাকা ও ৯৭ দশমিক ৫০ টাকা।

ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য জর্দা ও গুলের প্রতি দশ গ্রামের ঘোষিত ন্যূনতম খুচরা মূল্য যথাক্রমে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ও ২০ থেকে ২৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলোর ওপর সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক হবে যথাক্রমে ২৭ টাকা ও ২৫ টাকা।

সংসদ সদস্য শামিমা আক্তার খানম বলেন, এখন রেস্টুরেন্টে স্মোকিং জোন হচ্ছে। এখানে অনেক ছেলে-মেয়েরা স্মোকিং জোনে গিয়ে তামাক নিচ্ছেন। ধানমন্ডি, গুলশানের মতো এলাকায় রেস্টুরেন্টগুলোতে এখন জোন খুলে দেওয়ায় ছেলে-মেয়েরা অবাধে এসবে অভ্যস্ত হচ্ছে। এটি বন্ধ করতে হবে। পাঠ্যবইয়ে তামাক সচেতনতা নিয়ে পাঠ সংযুক্ত করতে হবে।

শেয়ার করুন