আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের জন্য ২০টি প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের দুটি প্রকল্প। এগুলো হচ্ছে কক্সবাজারের টেকনাফে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে নির্মিত কমিউনিটি স্পেস ও ঝিনাইদহের আরবান রিভার স্পেস।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় গত বৃহস্পতিবার (১ জুন) এই সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৪৬৩টি প্রকল্প থেকে নির্বাচকরা এই ২০টি প্রকল্প বাছাই করেন। ১০ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যমানের চূড়ান্ত পুরস্কারের জন্য লড়বে সংক্ষিপ্ত তালিকার প্রকল্পগুলো।
সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পাওয়া এসব স্থাপত্যকর্মের ছবি গত বৃহস্পতিবার থেকে লন্ডনের কিংস ক্রসে আয়োজিত এক প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হচ্ছে। ৩০ জুন পর্যন্ত এ প্রদর্শনী চলবে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
রোহিঙ্গা শিবিরে কমিউনিটি স্পেসের স্থপতি রিজভী হাসান, খাজা ফাতমী ও সাদ বিন মোস্তফা। তিনজনই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করেন ২০১৭ সালে। তিনজনের মধ্যে স্থপতি রিজভী হাসান ২০২০ সালে জাতিসংঘের ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাঁর কাজ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’।
রোহিঙ্গা শিবিরের সেই কমিউনিটি স্পেসের নকশার বিষয়ে কথা হয় স্থপতি খাজা ফাতমীর সঙ্গে। তিনি জানান, প্রথাগত পদ্ধতিতে কোনো নকশা বা মডেল তৈরি না করে সরাসরি রোহিঙ্গা কারিগরদের সঙ্গে কাজ করেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন তাঁরা।
খাজা ফাতমী বলেন, ‘গত্বাঁধা কোনো ভবন নয়, বরং এমনভাবে কাজটা করতে চেয়েছি যাতে পুরো জনগোষ্ঠীর উপকার হয়। বাঁশ, শন, গোলপাতা, বেতের মতো স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা পরিবেশবান্ধব কাঁচামাল ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়েছে টেকসই এই স্থাপনা। ’
তিনি জানান, ব্র্যাক, এইচসিএমপি এবং অ্যাকশনএইডের সহায়তায় ২০১৮ সাল থেকে রোহিঙ্গা শিবিরে মোট ছয়টি স্থাপনা নির্মাণ করেন তাঁরা। নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ উপযোগী স্থাপনাগুলো তৈরির সময় লক্ষ্য ছিল, যাতে মাটির কোনো ক্ষতি না হয়। রোহিঙ্গারা চলে যাওয়ার পরও যেন স্থাপনাগুলো ব্যবহার করা যায়।
স্থপতি সাদ বিন মোস্তফা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘একেকটি স্থাপনার আয়তন ১২০০ থেকে ৫০০০ বর্গফুটের মতো। প্রতি বর্গফুটে আমাদের খরচ হয়েছে মাত্র ৬০০ থেকে ৭০০ টাকার মতো। নারীবান্ধব ওই প্রকল্পের মাধ্যমে রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীদের জন্য স্থাপত্যকর্মের সামনে আঙিনা তৈরি করা হয়েছে। তাদের কাউন্সেলিংসহ নানা দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আছে সেখানে। ’
শাহ আলম, তাহরিমা আক্তার, হাসান তারেক, বিপ্লব হোসেন, শেখ জাহিদুর রহমান, মো. আব্দুল আলীম, আবিদ ইবনে রহমানসহ আরো অনেকে এই প্রকল্পে নানাভাবে সহায়তা করেছেন বলে জানালেন সাদ বিন মোস্তফা।
এদিকে পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতার পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক নগরায়ণের অনন্য উদাহরণ ঝিনাইদহের আরবান রিভার স্পেস। এর স্থপতি খন্দকার হাসিবুল কবির ও সুহাইলী ফারজানা। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাসিবুল কবির কো-ক্রিয়েশন আর্কিটেক্টসের প্রধান। ঝিনাইদহ শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে নবগঙ্গা নদী। সেই নদীর তীর ঘেঁষে হাঁটার রাস্তা, আড্ডা ও সংস্কৃতিচর্চার জায়গা তৈরি করেছেন তাঁরা। এটা পুরো এলাকার চিত্র বদলে দিয়েছে।
হাসিবুল কবির বললেন, ‘কাজটা শুরু করেছি ২০১৫ সালে। নদীকে কেন্দ্র করে নগর সাজাতে চেয়েছি আমরা। এ কাজে শহরের মেয়র থেকে শুরু করে হকার পর্যন্ত সবাইকে যুক্ত করেছি। ’
স্থপতি সুহাইলী ফারজানা বললেন, মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে স্থাপনা নির্মাণই আমাদের কাজের প্রধান উপজীব্য। নানাভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে ‘সিটি ওয়াইড পিপলস নেটওয়ার্ক’ও গড়েছি। আমাদের স্লোগান ‘নদী ও পুকুরের দিকে করি মুখ/বাড়িয়ে দেই ঝিনেদার সুখ’।
স্থাপত্য পুরস্কারের ক্ষেত্রে আগা খান অ্যাওয়ার্ড অত্যন্ত সম্মানজনক পুরস্কার। ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতি তিন বছর পর এই সম্মাননা দেওয়া হয়। সমকালীন নকশা, সামাজিক গৃহায়ণ, সামাজিক অগ্রগতি, উন্নয়নসহ অনেক দিকই বিবেচনা করা হয় এতে। আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের বাছাই পদ্ধতি অন্যান্য স্থাপত্য পুরস্কারের বাছাই পদ্ধতি থেকে ভিন্ন। শুধু স্থাপত্যের নান্দনিক দিকই নয়, সার্বিকভাবে জীবনের গুণগত মানোন্নয়নের দিকেও খেয়াল রাখা হয়। স্থাপনা বা ব্যক্তির পাশাপাশি এটি প্রকল্প, সম্প্রদায় ও এর অংশীদারদেরও স্বীকৃতি দেয়। পরিকল্পনা এবং ঐতিহাসিক সংরক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি উদ্ভাবনী ধারণায় স্থাপনাটি কতটা পরিবেশবান্ধব সেটিও দেখা হয়। প্রায় চার দশক যাবৎ স্থাপত্য অনুশীলনের মাধ্যমে মানবজাতির চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে আগা খান ফাউন্ডেশন কাজ করছে। এখন পর্যন্ত ১২১টি প্রকল্প পুরস্কৃত হয়েছে এবং প্রায় ১০ হাজার ভবনের প্রকল্প নথিভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশিদের মধ্যে এর আগে ২০১৯ সালে স্থপতি সাইফ উল হকের নকশা করা কেরানীগঞ্জের আর্কেডিয়া এডুকেশন প্রজেক্ট আগা খান পুরস্কার লাভ করে। ২০১৬ সালে এই পুরস্কার জিতেছিলেন স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম ও কাশেফ মাহবুব চৌধুরী।