বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রেখে দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে গম ও ভোজ্যতেলের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে।
আর সরকারের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে দেশে উৎপাদিত প্রধান খাদ্য চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। পাম অয়েল রপ্তানিতে শীর্ষ দেশ ইন্দোনেশিয়া পণ্যটির রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করায় পণ্যটির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কিছুটা কমলেও দেশের খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েনি বললেই চলে। বেড়েছে ডিম, মাছ, মাংস, মসলা ইত্যাদি খাদ্যপণ্যের দাম।
খাদ্যপণ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রধান উপায় হলো এসব খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা, যাতে এগুলোর জন্য আমাদের বৈদেশিক নির্ভরতা ন্যূনতম পর্যায়ে চলে আসে। কৃষি খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে একদিকে যেমন বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, তেমনই অন্যদিকে খাদ্যশস্য উৎপাদনে কৃষকদের বেশি করে উৎসাহী করতে প্রণোদনা ও ভর্তুকির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়াতে হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, কৃষি খাতে ভর্তুকি কেন? এর উত্তর হলো, জিডিপিতে কৃষি খাতের (শস্য উপখাত, প্রাণিসম্পদ ও পশু পালন উপখাত এবং বন উপখাত নিয়ে গঠিত) অবদান হ্রাস পেলেও এখনো ‘কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান কর্মকাণ্ড এবং জীবনীশক্তি’ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৮)। তাছাড়া সার্বিক জিডিপিতে কৃষির রয়েছে পরোক্ষ অবদান। বিশেষ করে বৃহৎ সেবা খাতের মধ্যে পাইকারি ও খুচরা বিপণন, হোটেল ও রেস্তোরাঁ এবং পরিবহণ, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ খাতের প্রবৃদ্ধিতে এ খাতের রয়েছে মূল্যবান অবদান। তাছাড়া সক্ষম শ্রমশক্তির ৪০ ভাগের বেশি কৃষিতে নিয়োজিত। তবে এটিও অনস্বীকার্য যে, কৃষি খাতের একসময়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধি হার ক্রমায়ে তলানিতে নেমে আসায় খাদ্যশস্যের জন্য আমাদের আমদানিনির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে। সরকারি তথ্য মোতাবেক ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৯ শতাংশ।
এরপর প্রবৃদ্ধি হার কমে ২০০৩-০৪ অর্থবছরে তা ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশে দাঁড়ায় (বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউ-২০০৫)। এরপর প্রবৃদ্ধির হার একটু একটু করে বেড়ে ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশে পৌঁছে। এরপর প্রবৃদ্ধি হারে আবার নিম্নমুখিতা দেখা দেয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘বিগত ১০ বছরে কৃষি খাতে ৩.৭ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।’
২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা বিবিএসের সাময়িক প্রাক্কলন অনুযায়ী হ্রাস পেয়ে চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) ২ দশমিক ২০ শতাংশে দাঁড়াবে। এটি সম্ভবত গত কয়েক বছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হারের সর্বনিম্ন রেকর্ড। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল এবং খাদ্যশস্যের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা গমের উৎপাদনের ওপর।
বাস্তবে বেশ কয়েক বছর ধরে চাল উৎপাদনে নেতিবাচক থেকে নিম্ন প্রবৃদ্ধি হার লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও অন্যান্য রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছর বাদ দিলে ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হার নেতিবাচক থেকে ১ দশমিক ৩০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। চাল উৎপাদনের এ প্রবৃদ্ধি হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের (১ দশমিক ৩৭ শতাংশ) চেয়ে কম।
আর খাদ্যশস্যের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা গমের চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চললেও এর উৎপাদন নব্বইয়ের দশকের শেষদিকের তুলনায় অনেক কম। সরকারি তথ্য মোতাবেক, ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন হয়েছিল ১৯ লাখ ৮ হাজার টন।
এটি এ পর্যন্ত বাংলাদেশে গমের সর্বোচ্চ উৎপাদন। এরপর থেকে গমের উৎপাদন কমতে থাকে এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ লাখ ২৫ টনে (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৯)। বিবিএসের সাময়িক হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্যটির উৎপাদন দাঁড়ায় ১০ লাখ ৮৫ হাজার টনে। চলতি অর্থবছরে দেশে গম উৎপাদনের পরিমাণ সরকারিভাবে প্রকাশ না করা হলেও অন্য এক সূত্রে পাওয়া তথ্য মোতাবেক, এ অর্থবছরে গমের উৎপাদন দাঁড়াবে ১১ লাখ ৬৭ হাজার টনে। গমের এ উৎপাদন দেশের চাহিদার (কম-বেশি ৭০ লাখ টন) ছয় ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ গমের ক্ষেত্রে দেশ প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর।
বৈশ্বিক খাদ্য সংকটকালে খাদ্যশস্যসহ (ধান, গম) সব ধরনের খাদ্যপণ্যের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হার বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি ঠিক, অতীতে সব সরকারই অবকাঠামো উন্নয়ন ও ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষিতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে।
তবে আগের সরকারগুলোর তুলনায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর সরকার কৃষিতে ভর্তুকি প্রদানের বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, এ সরকারের প্রথম বাজেটে (২০০৯-১০) কৃষি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি করে ৪ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। ভর্তুকির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
তবে ২০০৯-১০ অর্থবছরের ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৫ কোটি টাকার বাজেট ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হলেও সে অনুপাতে কৃষিতে ভর্তুকি বাড়েনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। এতে বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম হুহু করে বেড়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দুই-তিন বছর স্থায়ী হলে গম, ভুট্টা, ভোজ্যতেল, চিনি, গুঁড়া দুধ ইত্যাদি খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন যে প্রায় পুরোপুরি ভেঙে পড়বে এবং তুলনাহীন উচ্চমূল্যে এসব পণ্য আমদানি করা এশিয়া-আফ্রিকার অনেক দেশের পক্ষে কষ্টকর হবে, তা অনেকটা জোর দিয়ে বলা যায়। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে চাল রপ্তানিকারক দেশগুলো চালের রপ্তানি সাময়িকভাবে বন্ধ বা হ্রাস করে দিতে পারে। এতে চাল আমদানিনির্ভর দেশগুলো বিপদে পড়বে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে সারের দাম। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, ইউরিয়া সারের প্রতি কেজির মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে ৩২ থেকে বেড়ে ৯৬ টাকায় দাঁড়িয়েছে। টিএসপি ৩৩ থেকে বেড়ে ৭০ টাকা, এমওপি ২৩ থেকে বেড়ে ৫৪ টাকা এবং ডিএপি সারের দাম ৩৭ থেকে বেড়ে ৯৩ টাকায় পৌঁছেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের জোর আশঙ্কা দেখছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বেড়ে চলা খাদ্য সংকট বিশ্বকে একটি মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। যুদ্ধের কারণে খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক মজুত কমার পূর্বাভাস দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইন কাউন্সিল (আইজিসি)। রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘাতের ফলে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। আর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রধান ডেভিড বিসলি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যের দাম এতটাই বেড়ে যেতে পারে যে, তা বিশ্বের দরিদ্র মানুষের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
আগামী অর্থবছর খাদ্যশস্য, বিশেষ করে ধান উৎপাদনে বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বিশ্ববাজারে সারের আকাশছোঁয়া দাম। বিশ্ববাজারে সারের দাম বাড়লেও খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক পড়া এড়াতে কৃষক পর্যায়ে সারের দাম বাড়ানো যাবে না। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক যথার্থই বলেছেন, আগামী বছর কৃষি খাতে, বিশেষ করে সারসহ কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দের পরিমাণ না বাড়ানোর বিকল্প নেই। শুধু খাদ্যশস্যই নয়, ভোজ্যতেল, ডাল, গুঁড়া দুধ, চিনি, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ সব ধরনের মসলা, ফলমূলে আমরা অনেকটা আমদানিনির্ভর। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এসব খাদ্যপণ্যের দামও যে বেড়ে যাবে, তা জোর দিয়ে বলা যায়। খাদ্যশস্যসহ এসব খাদ্যপণ্যের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হার বাড়িয়ে আমদানিনির্ভরতা ন্যূনতম পর্যায়ে আনতে হবে। এজন্য যা প্রয়োজন তা হলো-কৃষিজমির অকৃষি খাতে ব্যবহার যথাসম্ভব বন্ধ, কৃষিব্যবস্থার পুরোপুরি আধুনিকায়ন এবং কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানো। আর যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, আমাদের কৃষিব্যবস্থা মূলত গ্রামভিত্তিক। গ্রামীণ অর্থনীতি শহুরে অর্থনীতির তুলনায় অনেকটা দুর্বল। কৃষিতে ভর্তুকির সুফল প্রধানত গ্রামের কৃষক ভোগ করেন। তাই কৃষিতে অধিক পরিমাণে বিনিয়োগ ও ভর্তুকি শহর-গ্রামের অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসে সহায়তা করে। আর যে বিষয়টি স্মরণে রাখতে হবে তা হলো, করোনা মহামারির সময় অর্থনীতির অন্যসব খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কৃষি খাত আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল। তাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট সৃষ্টি হওয়ায় এবং যুদ্ধের মেয়াদ দীর্ঘায়িত হলে এ সংকট আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকায় আগামী অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং তা হতে পারে চলতি বছরের ভর্তুকির দ্বিগুণ বা তার চেয়ে বেশি।
লেখক : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক