ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট-সুনামগঞ্জের পর এবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শেরপুর ও নেত্রকোণাতেও বন্যা দেখা দিয়েছে। এসব জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ।
ভারতে ত্রিপুরার রাজ্যের পাহাড়ি ঢল ও টানা দু’দিনের বর্ষণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার মনিয়ন্দ ইউনিয়নের কর্নেল বাজার সংলগ্ন আইড়ল এলাকায় হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে। ফলে কর্নেল বাজার থেকে আইড়ল গ্রামে যাওয়ার সড়কটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
শনিবার (১৮ জুন) ভোর থেকে প্রবল বেগে আসা পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে সড়কটি দ্বিখণ্ডিত হয়। এছাড়া বাঁধ ভাঙার কারণে আশপাশের ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, অনবরত পানি চাপে ফলে ধীরে ধীরে বাঁধটি ভেঙে আরও বড় হচ্ছে। ফলে পানিবন্দি অবস্থায় অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন আইড়ল এলাকাবাসী।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ— এখনও পর্যন্ত কোনো ত্রাণ সহযোগিতা আসেনি।
এছাড়া শুক্রবারের (১৭ জুন) বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের অন্তত পাঁচটি গ্রামে পানি ঢুকেছে। ফলে গ্রামগুলোর কিছু সড়ক পানিতে তলিয়ে আছে। ইতোমধ্যে পানিবন্দি কয়েকটি পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া আখাউড়া স্থলবন্দর সড়কের পাশের দোকান ঘরগুলোও পানিতে ডুবে আছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. শহগীর আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এরই মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। তালিকা তৈরি করে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।
অন্যদিকে ভারী বর্ষণে ভারত থেকে নেমে আসা উজানের পানিতে বন্যা দেখা দিয়েছে সীমান্তবর্তী জেলা শেরপুর ও নেত্রকোণাতেও। এসব জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলের পানিতে দ্বিতীয় দফায় শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশী ও সোমেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাবন দেখা দিয়েছে।
ভারতের মেঘালয়ের বিভিন্ন পাহাড়ি নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলায় এ বন্যা দেখা দিয়েছে।
উপজেলার মহারশী এবং সোমেশ্বরী নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সদর, ধানশাইল, গৌরীপুর, হাতিবান্দা ও মালিঝিকান্দাসহ ৫ ইউনিয়নের ২০ গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার রামেরকুড়া, দিঘীরপাড়, চতলের বেড়িবাঁধ ভেঙে উপজেলা সদর এবং আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ওইসব গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারুক আল মাসুদ জানিয়েছেন, দ্বিতীয় দফায় শুক্রবার সকাল থেকে উপজেলা সদরে ও বিভিন্ন গ্রামে পানি আসতে শুরু করেছে। বৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হলে বন্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। প্রথম দফায় বন্যার্তদের মাঝে জেলা প্রশাসনের বরাদ্দের ১৫ মেট্রিক টন চালের মধ্যে ইতোমধ্যে ১০ মেট্রিক টন বিতরণ করা হয়েছে। পানিবন্দিদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতে নেত্রকোণাতেও বন্যা দেখা দিয়েছে। কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও বারহাট্টা উপজেলায় বন্যা হচ্ছে। বিশেষ করে কলমাকান্দার পরিস্থিতি বেশি শোচনীয়। উপজেলার আটটি ইউনিয়নের ৩৪৩ গ্রামের মধ্যে বেশিরভাগ গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এতে প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
এদিকে টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলাসহ পুরো বিভাগের প্রায় ৮০ ভাগ প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী। বন্যার পানি প্রবেশ করায় বন্ধ করা হয়েছে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের ফ্লাইট ওঠানামা। সারা দেশে বাতিল করা হয়েছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা।
এদিকে দেশের উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলেও বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদী তিস্তা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দ্রুত বাড়ছে। এরই মধ্যে তিস্তা অববাহিকার চারটি জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, রংপুরে বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে পারে বলে মনে করছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।। ব্রহ্মপুত্রের পানি যমুনা দিয়ে নামার সময় তিন-চার দিনের মধ্যে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল পর্যন্ত বন্যার পানি চলে আসতে পারে।
ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর (আইএমডি) বলেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটির চেরাপুঞ্জিতে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা জুন মাসে ১২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত তিন দিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এটিও গত ২৭ বছরের মধ্যে তিন দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। চেরাপুঞ্জিতে আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরও ৫৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে, ব্রহ্মপুত্রের উজানে আসামের গৌহাটিতে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। এ দুই এলাকার ভাটি হিসেবে বাংলাদেশের সিলেট ও কুড়িগ্রামে ওই পানি নামা শুরু করবে। ফলে বন্যা দেখা দেবে কুড়িগ্রামেও।