এবার চীনের তুলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শিনজিয়াং প্রদেশে শিশুশ্রম ও শ্রম আইন লঙ্ঘন করে তুলা চাষের অভিযোগে এ পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি। জানা গেছে, মার্কিন মানবাধিকার ও শ্রম আইনে অনুমোদন নেই এমন প্রক্রিয়ায় তুলা উৎপাদন করায় উৎপাদিত সেই পণ্য নিষিদ্ধ করেছে দেশটি।
যেসব দেশ ও সংস্থা চীনের শিনজিয়াং অঞ্চল থেকে পণ্য আমদানি করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করবে তাদের পণ্যগুলো বাধ্যতামূলক শ্রম দিয়ে তৈরি করা হয়নি বলে নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে জিনজিয়াং প্রদেশের ফেবরিক শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ইউরোপে তার মিত্র দেশগুলোতেও রফতানি করা যাবে না। ফলে বলা যায়, চীনের জিনজিয়াংয়ের তুলা বাংলাদেশ কোনোভাবেই ব্যবহার করতে পারবে না। নিষেধাজ্ঞাটি জিনজিয়াংয়ের সব পণ্যে আরোপ করা হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মূল শঙ্কার কারণ তৈরি পোশাক শিল্পে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যখন করোনা ও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তখন এই নিষেধাজ্ঞা এলো। কারণ, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাত কাঁচামালের জন্য চীনের ওই প্রদেশটির ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে বিজিএমইএ জানিয়েছে। বলা হয়েছে, চীন থেকে তুলা আমদানির সময় জিনজিয়াংয়ের তুলা না পাঠানোর নিশ্চয়তা নিচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে জিনজিয়াংয়ের তুলা ও ফেবরিকস শনাক্তকরণের যন্ত্র আমদানি করার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ী নেতাদের অনেকেই বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পকে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশ পোশাকশিল্পের কাঁচামালের জন্য চীনের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল।
আগে জিনজিয়াং প্রদেশ থেকে দেশে তৈরি পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত তুলার ৩০ ভাগ আসতো। অন্য দেশ থেকে তুলা আমদানি করতে ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে পোশাকের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যেতে পারে।
তবে তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, জিনজিয়াং প্রদেশ থেকে অনেক আগে খুবই অল্প পরিমাণে তুলা আমদানি করা হতো। বর্তমানে চীনের ওই অঞ্চল থেকে কোনও তুলা আনা হয় না। ফলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরে এ নিয়ে উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। ফারুক হাসান বলেন, চীনের তুলার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর আমরা আমাদের গার্মেন্ট মালিকদের সতর্ক থাকতে বলেছি। প্রত্যেক গার্মেন্ট মালিককে বলা হয়েছে, কেউ যেন চীনের ওই এলাকা থেকে কোনও গার্মেন্ট তুলা বা অন্য কোনও কিছু না আনেন।
ফারুক হাসান দাবি করেন, চীনের তুলার ওপর নিষেধাজ্ঞার চেয়ে আমরা বেশি আতঙ্কে আছি বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া নিয়ে। ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় আমাদের অর্ডার কমে যাচ্ছে। এছাড়া রফতানির ক্ষেত্রে আরও বিভিন্ন ধরনের ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে টিকে থাকার লড়াইয়ে আমাদের ব্যয় কমানোর বিষয়টি নিয়ে এখন ভাবতে হচ্ছে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, চীনের তুলার ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এখনই বোঝা যাবে না, তবে এর প্রভাব পড়বে আরও দুই মাস পর। তিনি বলেন, চীন থেকে আমাদের অধিকাংশ কাঁচামাল আনতে হয়, ফলে সমস্যা কোনদিকে যাবে আমরা নিশ্চিত নই। তিনি উল্লেখ করেন, চীনের চেয়ে বড় আতঙ্কের বিষয় হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে অর্ডার কমে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মন্দা ও মূল্যস্ফীতি যেভাবে বাড়ছে তাতে অর্ডার যদি কমে যায়, তখন আমাদের কিছুই করার থাকবে না। আমরা আছি সেই ভয়ে।
ব্যবসায়ীরা জানান, চীন তুলনামূলক বাংলাদেশের কাছের দেশ হওয়ায় এবং কম সময়ে চীন থেকে পণ্য সরবরাহের সুবিধা থাকায় বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা অনেকটাই চীননির্ভর।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে সমস্যায় পড়বে উদ্যোক্তারা। গত এক বছর ধরে এমনিতেই তুলার বাজার অস্থির, তারপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর অস্থিরতা আরও বাড়বে। তুলা আমদানি করতে ব্যয় বাড়বে, ব্যয় বাড়লেও সুতা তৈরি করতে খরচ বাড়বে। তৈরি পোশাকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। আর সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব পড়বে রফতানি ব্যয়ে।
এতসব হতাশার মাঝে আছে আলোর রেখাও। মূল্যস্ফীতি ও মন্দার ভয়াল পদধ্বনিতে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি গন্তব্যে পোশাকের ক্রয়াদেশ কিছুটা কমতির দিকে থাকলেও চীন থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ক্রয়াদেশ ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনাও রয়েছে।
অবশ্য এর আগে যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিল। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীনও মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে। এরপর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে চীনা প্রযুক্তি নির্মাতা হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া ২০২১ সালে জিনজিয়াংয়ের টমেটো এবং তুলাও নিষিদ্ধ করে দেশটি।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের বহুদিনের অভিযোগ—২০১৭ সাল থেকে ১০ লাখের বেশি উইঘুর ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মুসলমানকে জিনজিয়াংয়ে আটকে রেখে খুব কম মজুরি বা বিনা মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।