বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশে বাঙালি জাতিগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এ দেশে রয়েছে ৫৪টির অধিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। তার মধ্যে সরকার ২০১১ সালে বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫তম অনুচ্ছেদ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও আজ অবধি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পরিচয়ের সংকট ঘোচেনি। এখনো স্বীকৃত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো ‘অন্য’ হিসেবে বিবেচিত; ‘অধীনস্থ’ হিসেবে পরিগণিত।
‘উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও সুবিধা থেকে কাউকে বাদ না রাখা’ (টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা ২০৩০, টার্গেট ১৬.৭)—এই স্লোগান বাংলাদেশ সরকার জোরালোভাবে সমর্থন করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তথা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সমান ও ন্যায়সঙ্গত পরিষেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সম্ভব না হওয়ার কারণ অনুধাবন ও তার সমাধানের উপায়সমূহ চিহ্নিতকরণের জন্য বর্তমান পলিসি গবেষণাটি ট্রেড ক্র্যাফট এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সমতল ভূমির ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর পরিচালনা করা হয়। এ গবেষণায় অংশগ্রহণকারী হিসেবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর পাশাপাশি বিদ্যমান সরকারি পরিষেবার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ব্যক্তিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, উপজেলা পর্যায়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ‘বিশেষ বরাদ্দ/পরিষেবা’ ব্যতীত অন্যান্য পরিষেবায় অংশগ্রহণ সামান্য। সরকার প্রদত্ত পরিষেবাগুলো, বিশেষত ‘প্রণোদনা বা ভাতা’ চাহিদা বিচেনায় অপ্রতুল ও অগ্রাধিকার বিবেচনায় তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বত্বাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত পরিষেবাপ্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য সেবা প্রদানের প্রক্রিয়া মোটেও সরল নয়। সরকারি অফিসগুলোতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অগ্রাধিকার নিশ্চিত না করে বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের সঙ্গে এক কাতারে বিবেচনা করা এই সংকট সৃষ্টির অন্যতম নেপথ্য কারণ। শুধু তাই নয়, সেবাগ্রহীতা বাছাই প্রক্রিয়া আত্মীয়তার সম্পর্ক ও তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ দ্বারা প্রভাবিত; তৃতীয় পক্ষের যুক্ততা আর্থিক অথবা অন্য কোনো সুবিধা দ্বারা নির্ধারিত। সম্পদ বণ্টনে যথেষ্ট অনিয়ম।
গবেষণায় দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেবা পাওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে অপেক্ষা করতে হয়। প্রথম প্রচেষ্টায় কোনো প্রকার সেবা না পেয়ে ফিরে আসা যেন একটি সাধারণ ঘটনা। এছাড়া তাদের চাহিদা ও দাবিগুলো যথাযথভাবে কর্মকর্তাদের কাছে প্রকাশে অন্তরায়, জাতিকেন্দ্রিক ভোগা, অবজ্ঞা, অবহেলা, বিদ্বেষ এবং ‘অন্য’তা প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সমস্যায়। ফলে সরকারি অফিসে যাওয়ার ক্ষেত্রে তারা দ্বিধাগ্রস্ত ও অনাগ্রহী। তবে কিছুটা আশাব্যঞ্জক চিত্র দেখা যায়, দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালিত এনজিও ও আদিবাসী সংগঠনের সদস্য সেবাপ্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতাগুলো কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ব্যতীত সমতল ভূমির ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য আলাদা কোনো পলিসি ও অ্যাক্ট নির্ধারণ করা হয়নি। প্রায় সব জাতীয় পলিসিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে বিক্ষিপ্তভাবে পলিসির রূপকল্প বা লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য বা মূলনীতির অংশে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। বেশির ভাগ জাতীয় পলিসিতে অসহায় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সরকারি পরিষেবায় অন্তর্ভুক্তির জন্য কিছু আখ্যান রয়েছে। কিন্তু কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই। প্রকৃত অর্থে প্রান্তিক এসব জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক মানদণ্ডে বিচার করা হয়েছে, যা সব জনগোষ্ঠীর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারি পরিষেবায় তাদের যথাযথ ও পর্যাপ্ত অন্তর্ভুক্তির চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতাসমূহ নানাবিধ। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সরকারি পরিষেবা সম্পর্কে তথ্যের ব্যাপক ঘাটতি, ব্যাপক হারে জাতিগত অবহেলা, বিদ্বেষ, ‘সংখ্যালঘু’ হিসাবে মূল্যায়ন, ত্রুটিপূর্ণ সেবাগ্রহীতা নির্বাচন প্রক্রিয়া, সম্পদের অসম বণ্টন, উদ্যোক্তা তৈরিতে ন্যুনতম সম্পদের অভাব, জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য সনদ না থাকা বা থাকলেও তাতে বানান ভুলের মতো নানা ধরনের ত্রুটি বিদ্যমান। রাষ্ট্রীয় পলিসিতে যতটুকু স্বীকৃত হয়েছে, তা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সব সময় উপেক্ষিত হচ্ছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে—ক. সরকারি পরিষেবা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সরকারি পরিষেবাগুলোর প্রতি চাহিদা বৃদ্ধি এবং সরকারি অফিস ও সেবাকেন্দ্র ব্যবহারের প্রতি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা। খ. ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসমূহের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে, বিশেষত উপজেলা পর্যায়ের সেবা প্রদানকারীদের আরো বেশি সংবেদনশীল করা। গ. বাঙালি জনগোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক সংহতি ও সৌহার্দ বৃদ্ধি। যেহেতু সামাজিক সংহতির বিষয়টি একটি জটিল প্রক্রিয়া, সেহেতু এটি কীভাবে বৃদ্ধি ও বজায় রাখা যায়, এ ব্যাপারে অ্যাথনোগ্রাফিক গবেষণার আলোকে কর্মপম্হা নির্ধারণ করা। ঘ. একটি একক ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন পরিষেবাগুলো সমন্বিতভাবে দেওয়া। ঙ. আয়বর্ধন ও উদ্যোক্তা তৈরির ট্রেনিংগুলো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং স্থানীয় বাজারে চাহিদা ও গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে দেওয়া প্রয়োজন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়