পাঁচ দশকের সাহিত্যিক জীবন সালমান রুশদির। এ সময়ের মধ্যে হত্যার হুমকি তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়। দ্বিতীয় উপন্যাস মিডনাইটস চিলড্রেন লিখে সর্বকালের অন্যতম সফল ব্রিটিশ লেখকদের একজন হয়ে উঠেছিলেন রুশদি। জিতেছেন বুকার পুরস্কার। তবে ১৯৮৮ সালে চতুর্থ উপন্যাস দ্য স্যাটানিক ভার্সেস প্রকাশের পর প্রচণ্ড বিতর্কের মুখে পড়েন তিনি।
একের পর এক হত্যার হুমকিতে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন ৭৫ বছর বয়সী এই লেখক। এর মধ্যেও থেমে থাকেননি তিনি। রচনা করেছেন একের পর এক সাহিত্য। কে এই সালমান রুশদি, কীভাবে তাঁর লেখকজীবনের শুরু, হুমকির মুখে তাঁর আড়ালে কাটানো জীবন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।
ব্রিটেনের কাছ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভের দুই মাস আগে বোম্বে শহরে (বর্তমান মুম্বাই) জন্ম নেন সালমান রুশদি। ১৪ বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ড চলে যান। রাগবি শহরের একটি স্কুলে ভর্তি হন। পরে কেমব্রিজের কিংস কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
এরপর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব অর্জন করেন রুশদি। এরপর বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপিরাইটার হিসেবে যোগ দেন। তখনই উপন্যাস লিখতে শুরু করেন তিনি। রুশদি প্রকাশিত প্রথম বই গ্রিমুস। এটি খুব বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। তবে সমালোচকেরা তখন তাঁকে উল্লেখজনক সম্ভাবনাময় লেখক হিসেবে দেখছিলেন।
এরপর দ্বিতীয় উপন্যাস মিডনাইট’স চিলড্রেন লিখতে পাঁচ বছর সময় নেন রুশদি। বইটি ভারতকে নিয়ে লেখা। ১৯৮১ সালে মিডনাইটস চিলড্রেনের জন্য বুকার পুরস্কার জিতে নেন রুশদি। বইটি ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। বইটির পাঁচ লাখ কপি বিক্রি হয়।
১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় রুশদির তৃতীয় উপন্যাস শেম। চার বছর পর দ্য জাগুয়ার স্মাইল নামে একটি ভ্রমণকাহিনি প্রকাশ করেন।
১৯৮৮ সালে তাঁর চতুর্থ বই দ্য স্যাটানিক ভার্সেস-এর জন্য তাঁকে ৯ বছর লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করা হয়েছে বলে মনে করেন মুসলিমরা। এটি প্রকাশের পর থেকে রুশদি হত্যার হুমকি পেয়ে আসছিলেন।
রুশদির নিজ জন্মশহর মুম্বাইতে মুসলিমদের ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল। তখন ১২ জন নিহত হন। তেহরানে ব্রিটিশ দূতাবাস লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করা হয়। বইটি প্রকাশের এক বছর পর ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সালমান রুশদির মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করেন। সেই সঙ্গে তাঁর মাথার দাম হিসেবে ৩ মিলিয়ন (৩০ লাখ) ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেন।
প্রথম ভারতে দ্য স্যাটানিক ভার্সেস বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় রুশদির বিরুদ্ধে মামলা হয়। দ্য স্যাটানিক ভার্সেস বইটির প্রকাশক প্রতিষ্ঠান ভাইকিং পেঙ্গুইনের লন্ডন কার্যালয়ে হামলা হয়েছিল। নিউইয়র্কে কার্যালয়ের কর্মীরা হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন।
তবে অনেক জায়গায় উপন্যাসটি প্রশংসা কুড়িয়েছে। হোয়াইটব্রেড পুরস্কারও জিতে নিয়েছে এটি। আটলান্টিক মহাসাগরের দুই অংশেই বইটি সর্বোচ্চ বিক্রি হয়েছে।
স্ত্রীকে নিয়ে পুলিশি সুরক্ষায় লুকিয়ে থাকা রুশদি মুসলিমদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য গভীর অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন। তবে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটিভুক্ত (ইইসি) দেশগুলো কট্টর মুসলিম প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ইইসিভুক্ত সব দেশ সাময়িকভাবে তেহরান থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
স্যাটানিক ভার্সেসকে কেন্দ্র করে হুমকিতে থাকা একমাত্র ব্যক্তি নন রুশদি। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে টোকিওর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্য স্যাটানিক ভার্সেসের জাপানি অনুবাদকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ বলেছিল, হিতোশি ইগারাশি নামের ওই অনুবাদক সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পারেটিভ কালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁকে বেশ কয়েকবার ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। নিজ কার্যালয়ের বাইরে হলওয়েতে তাঁর মৃতদেহ ফেলে রাখা হয়েছিল। তাঁর খুনিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ওই একই মাসে ইতালীয় অনুবাদক এতোরে ক্যাপ্রিওলোকে মিলানে নিজ অ্যাপার্টমেন্টে ছুরিকাঘাত করা হয়। অবশ্য ওই হামলার ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যান তিনি। নরওয়েতে বইটি অনুবাদ করেছিলেন উইলিয়াম নিগার্দ। ১৯৯৩ সালে অসলোতে নিজ বাড়ির সামনে তাঁকে গুলি করা হয়। তিনিও প্রাণে বেঁচে গেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে চার বিয়ে করেছেন সালমান রুশদি। তাঁর দুই সন্তান। বর্তমানে রুশদি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। সাহিত্যে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৭ সালে তাঁকে নাইট উপাধি দেন ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
২০১২ সালে স্যাটানিক ভার্সেস নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ককে কেন্দ্র করে তাঁর জীবনের স্মৃতিকথা লেখেন রুশদি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুক্তভাবে চলাচল করতে পছন্দ করতেন এই লেখক।
তবে মৃত্যুর হুমকি কখনো তাঁর পিছু ছাড়েনি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলে রেখেছেন, ‘রুশদির বিরুদ্ধে যে ফতোয়া দেওয়া হয়েছে, তা বুলেট ছোড়ার মতো। লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত না করা পর্যন্ত এটি থামবে না।’