হাতে পিস্তল, পরনে সাদা–কালো হাফহাতা গেঞ্জি। নিজেকে কক্সবাজারের উখিয়ার আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা দাবি করে মোহাম্মদ হাশিম নামের এক তরুণ ভিডিও বার্তায় চারজন রোহিঙ্গাকে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। ওই তরুণ বলেন, অন্যের প্ররোচনায় ও টাকার বিনিময়ে নিজেদের গোষ্ঠীর (রোহিঙ্গা) লোকজনকে গুলি করে হত্যা করা ঠিক কাজ হয়নি। এ জন্য দোষ স্বীকার করে ভিডিও বার্তায় তিনি জাতিগোষ্ঠীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন।
‘মো. আবদুল্লাহ মো. আবদুল্লাহ’ নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়েছে। ওই আইডির কাভার পেজে আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) লোগো রয়েছে। আজ বুধবার রাত সোয়া ১০টা পর্যন্ত ভিডিওটি ৫ হাজার ৫০০ শেয়ার হয়েছে। পোস্টের নিচে মন্তব্য পড়েছে ১২০টি। লাইক ও প্রতিক্রিয়া পড়েছে ১ হাজার ৭০০।
এক মিনিট ৩২ সেকেন্ডের ওই তরুণের ভিডিও বার্তাটি বুধবার ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তোলপাড় শুরু হয়। তৎপর হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই তরুণের খোঁজে বিকেল থেকে মাঠে নামেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ভিডিওটি সম্ভবত রাতে ধারণ করা। ভিডিওতে যাদের নাম এসেছে, তাদের পরিচয় শনাক্তসহ হাশিম নামের ওই তরুণকে আটকের চেষ্টা চলছে।
রোহিঙ্গাদের আঞ্চলিক ভাষায় ধারণ করা ওই ভিডিওতে মোহাম্মদ হাশিম এক হাতে পিস্তল প্রদর্শন করে প্রথমে সবাইকে সালাম দেন। তারপর নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আঁর নাম মোহাম্মদ হাশিম, বাপন (বাবা) নাম মৃত আবদু জব্বর, আঁই (আমি) বুচিডং অর (মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যের) কোয়ানচিমং পাড়ার। বাংলাদেশত হইলদে (আছি) ক্যাম্প-১৮, ব্লক-ইস্ট-৩। মাঝি আবদুল জব্বার।’
তারপর হাশিম বলেন, ক্যাম্প-১৮–এর ২৫ জন রোহিঙ্গা তরুণ-যুবককে ২৫টি পিস্তল দেওয়া হয়। তাঁদের পিস্তল দিয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ ইসলামি মাহাসের জিম্মাদার সাহাব উদ্দিন, রহমত উল্লাহ, হেড মাঝি ভূঁইয়া, মৌলভি রফিক। এই চারজন ওই সংগঠনের নেতৃত্ব দেন।
ভিডিও বার্তায় বলা হয়, ইসলামি মাহাসের কাজ হলো হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করা। মানুষ হত্যার জন্য ২৫ জন রোহিঙ্গা তরুণকে দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। তরুণদের মূল কাজ ছিল যারা প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করেন, তাদের হত্যা করা। গত ৫-৬ দিনের মধ্যে তারা (তরুণেরা) তিন মাঝিসহ এক স্বেচ্ছাসেবককে হত্যা করেছেন।
ভিডিও বার্তায় হত্যার শিকার রোহিঙ্গা মাঝিদের নামও বলেন মোহাম্মদ হাশিম। তারা হলেন ১৮ নম্বর ক্যাম্পের হেড মাঝি জাফর, ৭ নম্বর ক্যাম্পের ইসমাঈল, কুতুপালং সম্প্রসারিত ক্যাম্প-৪ এইচ ব্লকের এরশাদ ও হেড মাঝি আজিমুল্লাহ। মোহাম্মদ হাশিম নিজেকে ইসলামি মাহাসের সদস্য বলে পরিচয় দেন।
ভিডিওতে মোহাম্মদ হাশিমকে বলতে দেখা যায়, তাদের সামনে আরও বড় মিশন ছিল। কিন্তু তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। তাই এই খারাপ জগৎ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চান। ভিডিও বার্তার শেষ দিকে হাশিম বলেন, চারজন মাঝিকে হত্যার পর একসময় ইসলামি মাহাসের নেতারা তাদের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেন। তখন লাভ-ক্ষতির চিন্তা করতে থাকেন।
হাশিম বলেন, ভেবেছিলেন তারা নিজেদের ভাই-বন্ধুদের হত্যা করছেন, বংশ শেষ করে ফেলছেন। এটা অন্যায় কাজ হচ্ছে, বুঝতে পেরে ক্ষমা চাওয়ার জন্য ভিডিওর সামনে এসেছেন। তিনি মা-বোন সবার কাছে ক্ষমা চান। ভিডিওটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাতে ক্যাম্পের কোনো বসতিতে ভিডিওটি ধারণ করা। তরুণের পেছনে বাঁশের বেড়া আছে। ভিডিও বার্তার হাশিম নামের তরুণকে শিক্ষিত মনে হয়েছে এবং তিনি বার্তাটি কোথাও দেখে দেখে পড়ছিলেন। ভিডিওটি ধারণ করেছেন অন্য কেউ। পরিকল্পিতভাবে ভিডিওটি প্রচার করা হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
মোহাম্মদ হাশিমের এই ভিডিও ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্যাম্প-১১ (বালুখালী) আশ্রয়শিবিরের একজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, হাশিম নামের ওই তরুণ অনেকের পরিচিত মুখ। কিন্তু বেশ কয়েক মাস ধরে তিনি আত্মগোপনে। ভিডিও বার্তায় খুন হওয়া যে কয়েকজনের নাম বলা হয়েছে, তারা যে খুনের শিকার, এ কথা ঠিক। কিন্তু এই তরুণদের গুলিতে ওরা মারা গেছে, এ কথা জানা ছিল না কারও। ভিডিও প্রচারের পর থেকে আশ্রয়শিবিরে মাঝিসহ সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেন, ইসলামি মাহাস নামের সংগঠনটি আশ্রয়শিবিরে কয়েক বছর ধরে তৎপর আছে। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে দুই হাজারের বেশি মাদ্রাসা-মক্তব আছে। এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় বিদেশ থেকে পাঠানো টাকায়। টাকার ভাগাভাগি নিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষকেরা দ্বিধাবিভক্ত। একটি পক্ষ ইসলামি মাহাস, অন্যটি ওলামা পরিষদ ব্যানারে তৎপর। তবে ইসলামি মাহাস চলে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) সমর্থনে। ওলামা পরিষদ আশ্রয়শিবিরে প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করে।