ঘটে গেল দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্ল্যাকআউট। মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) দুপুর ২টা ৪ মিনিটে বিদ্যুৎ চলে যাওয়াকে শুরুতে অনেকেই ভেবেছিলেন সাধারণ লোডশেডিং। কিন্তু সময় গড়াতে জানা যায়, বড় রকমের ব্ল্যাকআউটের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের অর্ধেক অঞ্চল।
টানা ৬-৭ ঘণ্টা অন্ধকারে ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও এর আশপাশের এলাকার কয়েক কোটি মানুষ। এর আগে ২০১৪ সালের নভেম্বরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টার ব্ল্যাকআউট হয়।
মূলত বিদ্যুৎপ্রবাহের ফ্রিকোয়েন্সিতে (তরঙ্গ) গরমিলের কারণে ব্ল্যাকআউটের মতো ঘটনা ঘটে থাকে। সঞ্চালন লাইনে বিদ্যুৎপ্রবাহের রকমফের হলে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়াতে নিজ থেকে বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। একে বলে গ্রিড ট্রিপ (বিপর্যয়)।
বিভিন্ন কারণে সঞ্চালনে সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশে ৫০ মেগাহার্টজ তরঙ্গে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। কোনো কারণে এটি বেড়ে গেলে কিংবা কমে গেলে দেখা দেয় গ্রিড ট্রিপ। প্রাথমিক অবস্থায় মঙ্গলবারের ব্ল্যাকআউটের মূল কারণ ছিল এই গ্রিড ট্রিপ। তবে ঠিক কী কারণে এ গ্রিড বিপর্যয় ঘটল, তা এখনও জানায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
গ্রিড বিপর্যয় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও সঞ্চালন ব্যবস্থা এখনও রয়ে গেছে মান্ধাতা আমলের। এতে প্রায়ই ফ্রিকোয়েন্সিতে ভারসাম্যজনিত তারতম্য দেখা যায়, ঘটে বিপর্যয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় লোড ডেসপাস সেন্টার (এনএলডিসি) কোন এলাকায় কত ঘণ্টা, কত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও উৎপাদন হবে, তা এখনও ফোনে ফোনে ঠিক করে দেয়। এতে একটি ছোট বিপর্যয় সামাল দিতেও লেগে যায় দীর্ঘ সময়।
এ ছাড়া দেশের বেসরকারি পর্যায়ে স্থাপিত রেন্টাল-কুইক রেন্টালের যন্ত্রপাতি নিম্নমানের হওয়ায়, মানহীন জেনারেটর ব্যবহার করায়, বেজ লোড সেন্টার স্থাপিত না হওয়ায় সঞ্চালন লাইনে ঘটছে ঘনঘন বিপর্যয়।
এর আগে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে, ২০০২, ২০০৭, ২০০৯ ও ২০১৭ সালে জাতীয় গ্রিডে এ ধরনের বিপর্যয় ঘটেছিল। এ ছাড়াও নিম্নমানের সঞ্চালন লাইনের দরুন আঞ্চলিক গ্রিডে হরহামেশা এ ধরনের বিপর্যয় ঘটতে দেখা যায়।
২০১৪ সালের পরে কেন আবার একই বিপর্যয় ঘটল–এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক এ এইচ এম আসাদুল হক বলেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানো হলেও যেখান থেকে বা যার মাধ্যমে ট্রান্সমিশন ঘটবে, সেখানকার সরবরাহ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা হয়নি। ট্রান্সমিশন ও সরবরাহ লাইনে মানহীন যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য বারবার এমন বিপর্যয় ঘটছে। এ ছাড়াও ভোক্তা পর্যায়ে নজরদারি থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক অনেক দুর্বলতা এ ধরনের বিপর্যয়ের পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
পাওয়ার সেলের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এ হিসাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বোচ্চ সক্ষমতা থাকলেও এর সরবরাহ ব্যবস্থায় রয়ে গেছে বড় রকমের দুর্বলতা। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-এর ধীরগতিতে চলা নীতির কারণে এ ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিজিসিবির এক কর্মকর্তা বলেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের সঞ্চালন ব্যবস্থা এখনও যথেষ্ট দুর্বল। মূলত এখানে প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন প্রয়োজন। না হলে, সামান্য ভোল্টেজের ওঠানামা বা ফ্রিকোয়েন্সি ডাউন হয়ে গেলে এমন দুর্ঘটনা আবারও ঘটতে পারে।
গ্রিড ট্রিপের ব্যাপারে পিজিসিবির প্রধান প্রকৌশলী (সঞ্চালন-১) মোরশেদ আলম খান বলেন, ‘ফ্রিকোয়েন্সি ডাউন হয়েছে মূলত টেকনিক্যাল কারণে। আমাদের এখানে পুরোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সুযোগ নেই। বর্তমান বিশ্বে যেটা আধুনিক, সেটাই ব্যবহার করছি। ঠিক কী কারণে গ্রিড ট্রিপ হলো, এটি নিয়ে কমিটি তদন্ত করছে।’
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনিস আহমেদ বলেন, ‘পিজিসিবি যদি না বলে আসল সমস্যাটা কোথায়, তাহলে বাইরে থেকে সেটা জানা আমাদের জন্য মুশকিল। তবে সাদা চোখে যেটা বোঝা যায়, মেইনটেনেন্সের সমস্যার জন্যই এ বিপর্যয় ঘটেছে। প্রতিটি যন্ত্রপাতিরই একটি মেয়াদ থাকে। এগুলো পুরোনো হয়ে গেলে এক সেকেন্ডের ফ্রিকোয়েন্সি ডাউনে বড় রকমের বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। আমার মনে হয়, এমন কিছু একটাই ঘটেছিল। এ ব্যাপারে পিজিসিবিকে জানাতে হবে, আসল সমস্যাটা কোথায়। সমস্যা না জানলে তো সমাধান দেয়া সম্ভব নয়।’
এদিকে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলন মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘কন্ট্রোল সিস্টেম এতটাই উন্নত করা হয়েছে যে, কোনো কারণে সঞ্চালন লাইন ট্রিপ বা কোনো উৎপাদনকেন্দ্র হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলেও ফ্রিকোয়েন্সি ট্রিপ করে একযোগে সব কেন্দ্র বন্ধ হয়ে ব্ল্যাকআউট হওয়ার কোনো অবকাশ নেই বললেই চলে। এটা বিদ্যুৎ বিভাগের সবাই জানেন। কিন্তু বিদ্যুতের এত উন্নয়নের পরও এমন বিপর্যয় মেনে নেয়া কঠিন।’
সামগ্রিক বিদ্যুৎ বিপর্যয় নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, এটা উন্নত যন্ত্রপাতির বিষয় নয়। অনেকেই বলছেন যন্ত্রপাতির কথা। যখন গ্রিডের সঙ্গে গ্রিড কোডের নির্দেশনার সমন্বয় ঘটে না, তখন এ ধরনের বিপর্যয় ঘটে। বাকি সব বিষয় বাদ দিলেও ৩০ শতাংশ প্ল্যান্ট গ্রিডের আওতাভুক্ত হয়নি–এটা অস্বীকার করা যাবে না। এতে সাপ্লাই-ডিমান্ডে একটা বড় রকমের সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। সরবরাহের বিপরীতে চাহিদা যখন মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যায়, তখন জেনারেটরগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয়। অল্প সময়ের ব্যবধানেই এমন বিপর্যয় ঘটে যায়।
বিপর্যয় রোধে করণীয় কী–এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, কোথায় কত টাকা বিনিয়োগ করছি, তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোম্পানিগুলো গ্রিড কোডের নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলছে কি না। যতদিন পর্যন্ত গ্রিড কোডের নির্দেশনা লঙ্ঘন করা হবে, ততদিন এমন বড় বড় বিপর্যয়ের ঝুঁকি থেকে যাবে।
দেশে নির্মিত হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকল্পটিতে সঞ্চালন লাইনের কাজ এখনও অর্ধেকের বেশি বাকি। সাত প্যাকেজের আওতায় চলছে এ কাজ। এর মধ্যে যমুনা ও পদ্মা নদীর এপার-ওপার সঞ্চালন লাইন নির্মাণে কাজ হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। এ ছাড়াও হাতে রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় বড় প্রকল্প। কিন্তু সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নতি না করে একের পর এক কেন্দ্র বসিয়ে দেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা যাবে না–এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।