রাশিয়া ‘পরমাণু হামলা’ চালাচ্ছে কি না বোঝা যাবে যেভাবে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

গত ১৭ অক্টোবর বেলজিয়ামে ‘স্টেডফাস্ট নুন’ নামে একপাক্ষিক পারমাণবিক মহড়া শুরু করেছে ন্যাটো। ধারণা করা হচ্ছে, এ মাসের শেষের দিকে রাশিয়া নিজস্ব পারমাণবিক মহড়া চালাবে। চলতি বছরে এটি হবে তাদের দ্বিতীয় পারমাণবিক মহড়া। ন্যাটোর মহড়ায় অংশ নিচ্ছে ১৪টি দেশের মোট ৬০টি বিমান, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বি-৫২ বোমারু বিমানও রয়েছে। ন্যাটোর দাবি, ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে এই মহড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি রুটিনমাফিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম মাত্র।

কিন্তু এর প্রেক্ষাপট বলছে ভিন্ন কথা। এ সপ্তাহে একটি বড় ইউরোপীয় যুদ্ধে পারমাণবিক হামলার অনুশীলন করবে ন্যাটো। কিছু বিশ্লেষকের আশঙ্কা, এটি পারমাণবিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

মহড়ার সময়টিও উদ্বেগজনক বলে মনে হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি কমই দেখা যাচ্ছে। তবে রুশ বাহিনী যত বেশি পিছু হটতে বাধ্য হবে, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা ততই বাড়বে। তিনি একাধিকবার এমন হুমকিও দিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যেমন বলেছেন, ১৯৬২ সালে কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের পর থেকে পরমাণু যুদ্ধের সবচেয়ে বড় হুমকিতে রয়েছে বিশ্ব।

ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র ‘মিনিটম্যান ৩’ নামে একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা-উৎক্ষেপণ স্থগিত করেছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল, এটিকে উত্তেজনাবর্ধক বলে মনে করা হতে পারে। তারপর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। পশ্চিমারা মনে করে, রাশিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে ‘বিপর্যয়কর’ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা প্রয়োজন। ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, স্টেডফাস্ট নুন মহড়া বাতিল করার অর্থ হবে দুর্বলতা দেখানো।

কথা হলো, পুতিন যদি সত্যিই পারমাণবিক হামলা চালান, তাহলে কি বিশ্ব আগাম কোনো সতর্কবার্তা পাবে? সম্ভবত, বলছে অভিজ্ঞ পশ্চিমা সূত্রগুলো। স্যাটেলাইটসহ অন্যান্য প্রযুক্তিগত ব্যবহার করে হয়তো সতর্কবার্তা পাওয়া যাবে। তবে অনেক কিছুই নির্ভর করবে রাশিয়া কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করছে তার ওপর।

২০১০ সালে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সই হয়েছিল ঐতিহাসিক ‘নিউ স্টার্ট’ চুক্তি। এর আওতায় দুই দেশের দূরপাল্লার কৌশলগত অস্ত্রাগারগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। চুক্তি অনুসারে, উভয়পক্ষ ক্ষেপণাস্ত্র, বোমারু বিমান ও সাবমেরিন মিলিয়ে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৫০টি ওয়ারহেড মোতায়েন করতে পারে।

সমস্যা হলো, এর মধ্যে বহু ওয়ারহেড উচ্চমাত্রায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই সেগুলো নিক্ষেপ করা যেতে পারে। স্যাটেলাইট ও গ্রাউন্ড রাডারগুলো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার পরপরই তা শনাক্ত ও ট্র্যাক করতে পারে। কিন্তু কম উচ্চতায় উড়ন্ত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করা কঠিন।

তবে ইউক্রেন যুদ্ধে এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা কম। কারণ, এতে পশ্চিমারা তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে ভেবে ভুল করতে পারে এবং তার ফলে যুদ্ধে ন্যাটো জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যাবে। আপাতত রাশিয়ার গ্রোম পারমাণবিক মহড়া নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে ন্যাটো। এ ধরনের মহড়ায় অতীতে সাবমেরিন থেকে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানো হয়েছিল।

রাশিয়ার জন্য আরেকটি সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে, তার দুই হাজার ‘ট্যাকটিক্যাল’ পারমাণবিক অস্ত্রের বিশাল বহর থেকে একটি বা দুটি ব্যবহার করে সীমিত পরিসরে হামলা চালানো। এসব অস্ত্রে সাধারণত বিস্ফোরক ও পাল্লা কম হয়ে থাকে। ইউরোপে ন্যাটোর এ ধরনের প্রায় ১০০টি অস্ত্র মোতায়েন রয়েছে।

রাশিয়ার ট্যাকটিক্যাল ওয়ারহেডগুলো কয়েক ডজন স্টোরেজ সাইটে রাখা হয়েছে। ফলে সেগুলো ব্যবহারের প্রস্তুতি শনাক্তযোগ্য হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে মূল বিষয় হবে, স্যাটেলাইট ও অন্যান্য উপায়ে স্টোরেজ সাইট থেকে ওয়ারহেড পরিবহনের ওপর নজর রাখা।

ওয়ারহেডগুলো ট্রেন বা লরির মাধ্যমে পরিবহন করা হবে। সঙ্গে থাকবে ফায়ার-ইঞ্জিন ও বিশেষ পুনরুদ্ধার যান। এগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে রাশিয়ার এলিট ইউনিটের সদস্যরা। এছাড়া, যে সামরিক ইউনিট অস্ত্রগুলো ব্যবহার করবে, তারাও অস্বাভাবিক গতিবিধি দেখাতে পারে। বেড়ে যেতে পারে ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ।

পশ্চিমা দেশগুলো এসব লক্ষণ বেশ ভালোভাবেই জানে। কারণ, স্নায়ুযুদ্ধের পর কো-অপারেটিভ থ্রেট রিডাকশন (সিটিআর) কর্মসূচির আওতায় পারমাণবিক অস্ত্রাগারের সুরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করার বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে কয়েক দশক ধরে কাজ করেছে তারা। রাশিয়ার কিছু বিশেষায়িত সরঞ্জাম ও পদ্ধতি পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় নকশা করা হয়েছিল।

সিটিআর সম্পর্কে অভিজ্ঞ উইলিয়াম মুন বলেন, ওয়ারহেডগুলোর অতিরিক্ত গতিবিধি দেখা যাবে, তা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু, সীমিত শক্তি প্রদর্শনের জন্য রাশিয়া লরিতে লুকিয়ে একটি বা দুটি ওয়ারহেড বের করে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এ ধরনের পদক্ষেপ শনাক্ত করা কঠিন।

জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ গবেষণা ইনস্টিটিউটের পাভেল পডভিগ বলেন, একবার মোবাইল ক্ষেপণাস্ত্র-লঞ্চারে বসানো হয়ে গেলে এবং জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে ফেললে ‘ট্যাকটিক্যাল’ পারমাণবিক অস্ত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। তবে সেটি দেখা হচ্ছে কি না রাশিয়া তা জানবে না। তারা এ বিষয়ে কখনোই নিশ্চিত হতে পারবে না।

তাছাড়া, ওয়ারহেডের গতিবিধি গোপন রাখা রাশিয়ার উদ্দেশ্যেরও বিরুদ্ধে যাবে। থিংক-ট্যাংক কার্নেগি এনডাউমেন্টের জেমস অ্যাক্টন বলেন, পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রস্তুতি নিলে তা আমাদের জানাতে চাইবেন। তবে তিনি বাস্তবে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের চেয়ে হুমকি দিতেই বেশি পছন্দ করবেন।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

শেয়ার করুন