শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ নিয়ে এক যুগ আগের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় দেশের মানুষ। যে বিদ্যুৎ বিভাগ গত কয়েক বছরে লোডশেডিং শব্দটা উচ্চারণ করত না, তারাও এখন লোডশেডিংয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছে।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরপর তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলোর অন্যতম বিদ্যুৎ। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের আগে দেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির যে দশা ছিল, তা এক কথায় ভয়াবহ। তখন এরকম একটি প্রবাদ চালু হয়ে গিয়েছিল যে, ‘বিদ্যুৎ যায় না, মাঝে মধ্যে আসে।’ তখন দৈনিক মাত্র তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো, যা ছিল চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট কম। ফলে বিদ্যুৎ সংকটের কারণে মুখথুবড়ে পড়ে শিল্প-কারখানা; শ্লথ হয় অর্থনীতির চাকা।
বিএনপির পতন বা তাদের বিরুদ্ধে যেসব ইস্যুতে আওয়ামী লীগ জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল, তার অন্যতম প্রধান ছিল এই বিদ্যুৎ। যে কারণে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ শুরু করে শেখ হাসিনা সরকার। আইন করে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় এবং বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। জেনারেটরের ওপর থেকে ট্যাক্স তুলে দেওয়া হয় এবং শিল্প কারখানার মালিকদেরও নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে বলা হয়। শুধু তাই নয়, তারা চাইলে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবেন বলেও বিধান করা হয়। এভাবে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে।
যদিও বেসরকারি খাতের কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারকে নানা ধরনের সমালোচনার মুখেও পড়তে হয় এর খরচ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্তি দেওয়ার বিধানের কারণে। কেননা ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’কে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয় এবং এই আইনের অধীনে গৃহীত কোনো কাজের বৈধতা সম্পর্কে আদালতের কাছে প্রশ্ন করা বা মামলা করা যাবে না বলেও উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ যারা বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবেন, তাদেরকে আগে থেকেই দায়মুক্তি দেওয়া হয় এই বিশেষ আইনে।
তবে এটা ঠিক যে, বিদ্যুতের যে ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল, তা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের যেসব পদক্ষেপ তাৎক্ষণিকভাবে প্যারাসিটামলের ভূমিকা রেখেছে, তার মধ্যে এই বিশেষ বিধান আইন একটি। অর্থাৎ অতিরিক্ত খরচের বিনিময়ে হলেও সংকট সামাল দেওয়া গেছে। এভাবে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের আরও নানাবিধ পদক্ষেপে ২০২২ সালের ২১ মার্চ দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার ঘোষণা দেওয়া হয়। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের সময় এই ঘোষণা দেন।
তবে ট্র্যাজেডি হলো, শতভাগ বিদ্যুতায়নের এই ঘোষণার ছয় মাসের মধ্যেই বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে নাজেহাল হতে থাকে দেশের মানুষ। ৪ অক্টোবর গ্রিড বিপর্যয়ের কারণে দেশের একটি বড় অংশ বিদ্যুৎহীন (ব্ল্যাকআউট) হয়ে পড়লে এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। অবশ্য এর আগে থেকেই রেশনিং করে বা পালাক্রমে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং এবং কোথাও দিনে তিন-চারবার এবং প্রতি বারে অন্তত এক ঘণ্টা কওে লোডশেডিং শুরু হয়। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে ২০০৯ পূর্ববর্তী স্মৃতি মনে করতে থাকেন দেশের মানুষ। অনেকে রসিকতা করে বলতে থাকেন, মানুষকে ‘বিদ্যুৎ আসার’ স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
রসিকতা যতই হোক, নির্মম বাস্তবতা হলো, চাহিদার তুলনায় যে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না, তার পেছনে বড় কারণ গ্যাসের উৎপাদন কমে গেছে এবং মজুতও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তার বিপরীতে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকার পরেও যেরকম তৎপরতার সাথে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান করার কথা ছিল, তা হয়নি। বরং এলএনজি আমদানির প্রতি সরকারের বেশি আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। তার পেছনে একটি যুক্তি দেওয়া হয় যে, গ্যাস অনুসন্ধান করলেই যে পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এটা অনেকটা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। ফলে অনুসন্ধান কার্যক্রমে খরচ করা অর্থ পুরোটাই অপচয় হতে পারে, আবার গ্যাস পাওয়া গেলে বিপুল লাভও হতে পারে। সরকার সেই ঝুঁকিটা নিতে চায়নি বা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তারা বিদ্যমান গ্যাস দিয়ে যতটা সম্ভব বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বাকিটা তেল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ এবং এলএনজি আমদানি করে মোকাবিলা করতে চেয়েছে।
কিন্তু এটি কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয়। গত ১২ বছর ধরে যদি অব্যাহতভাবে গ্যাস অনুসন্ধান করা হতো তাহলে এতদিনে অন্তত একটি নতুন ক্ষেত্রও হয়তো আবিষ্কৃত হতে পারতো। কারণ তার ইঙ্গিত রয়েছে। বাংলাদেশের মাটির নিচে যে গ্যাস রয়েছে, সে কথা প্রমাণিত। সুতরাং যেসব জায়গায় সম্ভাবনা বেশি, সেসব জায়গায়ও গভীর অনুসন্ধান করা হয়নি। এমনিক সাগরের মীমাংসিত ব্লকে গ্যাস উত্তোলনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং সরকার নিজের করা টেন্ডারও বাতিল করেছে। সাধারণত, গ্যাস অনুসন্ধানের বৈশ্বিক সাফল্যের হার প্রতি সাত কূপে একটি। কিন্তু বাংলাদেশে এ অনুপাত প্রতি তিন কূপে একটি। গ্যাস অনুসন্ধানে প্রায় দ্বিগুণ সাফল্যের হার থাকা সত্ত্বেও দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের কাজ সেভাবে শুরু হয়নি।
এসবের পেছনে সরকারের টাকা খরচ করতে না চাওয়া এবং এলএনজি আমদানির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের প্রভাব থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এখন যখন বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে গেছে এবং মানুষের যখন আবার মোমবাতি ও হারিকেনের যুগে ফেরার দশা হয়েছে, তখন সরকার বা নীতির্ধারকেরা ঠিকই গ্যাস অনুসন্ধানের বাস্তবতা উপলব্ধি করছেন।
বাস্তবতা হলো, গত এক দশকে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে চাহিদা তথা ব্যবহার বেড়েছে। এর মধ্যে গ্যাসের বড় কোনো মজুদও আবিষ্কার না হওয়ায় পুরনো ক্ষেত্রগুলোর উপরে বেশি চাপ পড়ছে, সেগুলোর উৎপাদনও কমে আসছে।
গ্যাসের উৎপাদন কম হওয়ায় শুধু যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এর প্রভাব পড়ছে তাই নয়, অনেক দিন ধরেই পাইপলাইনের মাধ্যমে যে গ্যাস সরবরাহ করা হয়, সেখানেও তীব্র সংকট। রাজধানী এবং আশেপাশের নাগরিকদের এটা এখন খুব সাধারণ অভিযোগ যে, সকাল ৮টার পরে, আবার কোথাও ৮টার মধ্যে গ্যাস চলে যায়, আসে বিকেলে। অর্থাৎ মানুষের রান্নাবান্নার কাজে যখন সবচেয়ে বেশি গ্যাসের প্রয়োজন হয়, তখনই গ্যাস নেই। ফলে বাধ্য হয়ে মধ্য রাতে বা শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে রান্না করতে হয়। এভাবে সবাই এই পথ অনুসরণ করা শুরু করলে দেখা যাবে এই সময়েও গ্যাসের চাপ কমে যাবে।
গ্যাসের এরকম তীব্র হাহাকার থাকলেও পোস্ট পেইড মিটারের গ্রাহকদের দুই চুলার জন্য মাস শেষে ১০৮০ টাকা বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে। অথচ পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে চারজনের একটি পরিবার মাসে এখন হয়তো তিনশো টাকার গ্যাসও পায় না। প্রিপেইড মিটারের গ্রাহকেরা এক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। অর্থাৎ গ্যাসের চাপ কম থাকলে বা গ্যাস কম ব্যবহার করলে তাদের বিলও দিতে হয় সেই অনুসারে। কিন্তু পোস্ট পেইড গ্রাহকদের উভয় সংকট। তারা গ্যাস পাচ্ছে না, উল্টো নিয়মিত বিল দিয়ে যেতে হচ্ছে।
শুধু বাসা বাড়ি নয়, গ্যাস সংকটের কারণে ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, কোনাবাড়ী, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশের শিল্প-কারখানায় উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। দিনের একটা বড় সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। আবার গ্যাসের বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কল-কারখানা চালু রাখা অনেক ব্যয়বহুল। তাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। বাসাবাড়িতে অনেকে বৈদ্যুতিক চুলার ব্যবহার করেন। কিন্তু যখন দিনের একটা বড় সময় বিদ্যুৎ থাকছে না, তখন ওইসব চুলাও ব্যবহার করা যায় না। উপরন্তু বৈদ্যুতিক চুলার ব্যবহার বাড়লে বিদ্যুতে আরও চাপ বাড়বে। তখন লোডশেডিংও বাড়াতে হবে। আবার এর ফলে গ্রাহকের বিদ্যুতের বিলও বেড়ে যাবে। সব মিলিয়ে পুরো গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে মানুষকে এখন একদিকে অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে। আবার সেই টাকা খরচ করেও তারা কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না।
দেশের ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের একটি খবরে বলা হয়, গত দুই দশকে কোনো নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হওয়ায় আগামী ১০ বছরের মধ্যেই প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ার মতো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশে যদি বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া না যায়, তাহলে বিভিন্ন খাতের শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেহেতেু আমাদের পুরো শিল্প অবকাঠামো গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। তাই হঠাৎ করে গ্যাস সাপ্লাইয়ে সংকট দেখা দিলে সেটি অর্থনীতিতে বিরাট বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
এই সবকিছুর একমাত্র সমাধান হচ্ছে নিজস্ব গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো; নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য অনুসন্ধান জোরদার করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ানো। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর অনাবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র থাকলেও অনুসন্ধান কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। সাগর এলাকায়ও গ্যাস অনুসন্ধানে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সেজন্য বাপেক্সকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এখন থেকে চেষ্টা করলে আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে নতুন কয়েকটি ভালো মজুদের গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব নয়। সমতল ভূমি ও উপকূলীযয় এলাকার পাশাপাশি পাহাড়ি এলাকায়ও গ্যাসের অনুসন্ধান করা জরুরি।
পেট্রোবাংলার তরফে বলা হচ্ছে, দেশের পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রে গভীর খননকাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এগুলোর মধ্যে দুটি বাপেক্স-পরিচালিত মোবারকপুর ও শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্রে খনন করা হবে। অন্য দুটি খনন হবে বিজিএফসিএল-পরিচালিত তিতাস ও বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্রে। বাকি একটির অবস্থান এসজিএফএল-এর রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রে (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১৮ এপ্রিল ২০২২)।
প্রসঙ্গত, ১৮৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তিতাসভিলে তেল আবিষ্কৃত হওয়ার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একইসাথে তেল ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান, খনন এবং উত্তোলন প্রযুক্তির প্রসার ঘটে। বাংলাদেশে প্রথম প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কৃত হয় ১৯৫৫ সালে সিলেটে এবং প্রথম ব্যবহার শুরু হয় ১৯৬১ সালে ছাতক সিমেন্ট কারখানায় (অধ্যাপক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, জ্বালানির সমস্যা: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত, পৃষ্ঠা ৫)।
পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। গ্যাস মজুদের হিসাবে বাংলাদেশের আগে আছে পাকিস্তান, ভারত, চীন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। আর বাংলাদেশের পরে আছে ব্রুনাই, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড। ভালো ব্যাপার হলো বাংলাদেশের মাটির নিচে যে গ্যাস পাওয়া যায় সেটি পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক গ্যাসের তুলনায় অনেক বিশুদ্ধ। তাছাড়া বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধান কার্যক্রমে এটি স্পষ্ট যে, এ দেশের ভূগর্ভে আরও বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে (বদরুল ইমাম, বাংলাদেশে তেল সম্ভাবনা ও হরিপুর তেল বিতর্ক, পৃষ্ঠা ১০২)।
বর্তমানে দেশের ২২টি গ্যাসক্ষেত্রে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি ঘনফুট। সে তুলনায় বার্ষিক ব্যবহার বা চাহিদা হচ্ছে এক লাখ কোটি ঘনফুট। ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আরপিএস এনার্জি লিমিটেডের হিসাব, ও সম্প্রতি আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাওয়া ধারণা অনুযায়ী, দেশের ২৭টি বাণিজ্যিক গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের মোট প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মজুদ ২৯.৫৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। তবে পেট্রোবাংলার উপাত্ত অনুযায়ী মোট গ্যাস মজুদের ২০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট ২০২১ সালের মধ্যে তুলে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ এখন ১০ ট্রিলিয়ন ঘনফুটের বেশি মজুদ নেই। নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হলে এবং প্রকৃতি সদয় না হলে প্রতি বছর এক লাখ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের হিসাবে ১০ বছর পরে এই মজুদ শূন্য হয়ে যাবে। তখন পরিস্থিতি কী হবে?
সুতরাং বিদ্যমান গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ, শুকিয়ে যাওয়া ও পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্রগুলো সংস্কার করার পাশাপাশি নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের কর্মসূচিকে সরকারের এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে নিয়ে আসা দরকার। বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়নে ২০০৯ সালের পরে সরকার যেরকম ‘অ্যাগ্রেসিভ’ ছিল, এখন গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো এবং নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারেও সেরকম জোরালো পদক্ষেপের বিকল্প নেই। বিকল্প যদি হয় আমদানি, তবে সেই বিকল্পের মাশুল গুনতে হবে জনগণকে, রাষ্ট্রকে। তারও চেয়ে বড় কথা, বিশ্ব পরিস্থিতির খারাপ হয়ে গেলে পয়সা দিয়েও গ্যাস পাওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে নিজের সম্পদই ভরসা। সেই সম্পদের বিপুল সম্ভাবনা যেহেতু রয়েছে, অতএব সেটিকে কাজে লাগাতে হবে। নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য পয়সা খরচ করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এই অনুসন্ধানের নামে যেন আবার জনগণের পয়সার শ্রাদ্ধ না হয়। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যেরকম উন্নয়ন প্রকল্প মানেই বিরাট অংকের লুটপাট বিষয়টা বেশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, সেরকম অনিয়ম ও লুটপাট যাতে না হয়, সেটি রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হবে। এমনিতেই জ্বালানি খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে নানা গল্প ও ধারণা প্রচলতি আছে। ফলে গ্যাস অনুসন্ধানের নামে যাতে জনগণের পয়সা তছরুপ না হয়, বরং দেশের অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধি এবং সর্বোপরি মানুষের জীবনমান যেহেতু এখন হুমকির মুখে, সুতরাং এই ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীল নীতি গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এটি এখন বাঁচামরার প্রশ্ন। অর্থাৎ গ্যাসের উৎপাদন ও মজুদ বাড়াতে না পারলে বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।