জাতির পিতা ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর শুরু হওয়া সামরিক শাসনামলে দেশের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের নাক গলানো লজ্জাজনকভাবে প্রথম প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। সামরিক সরকার কী করবে, কীভাবে করবে- এসব নির্দেশনা আসতে থাকে বিদেশ থেকে। সময়ের বিবর্তনে তাদের এ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চিত্রে কিছুটা পরিবর্তন এলেও খুব কমছে বলার সুযোগ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পঞ্চাশ বছর পরও নেই।
অন্যবারের মতো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কয়েকটি দেশের ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের ‘অতি উৎসাহজনিত অতি তৎপর কর্মকাণ্ডের’ কথা প্রায়ই গণমাধ্যমে আসছে। আর্ন্তজাতিকভাবে নির্ধারিত শিষ্টাচার না মেনে কীভাবে, কেন ও আমাদের রাজনীতির কোন দুর্বলতার সুযোগে বিদেশি কূটনীতিকরা স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছেন, তা সব পক্ষকে গভীরভাবে ভাবতে হবে।
আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, গত জুলাই মাসে ঢাকায় অবস্থিত বিদেশি সব দূতাবাস, জাতিসংঘের কার্যালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে চিঠি পাঠায় আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৷ চিঠিতে ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ও ১৯৬৩ সালের কনস্যুলার সম্পর্ক নীতি মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়৷
ঢাকায় নিযুক্ত সব কূটনীতিক নিশ্চয় জানেন, ভিয়েনা কনভেনশেন অনুযায়ী তাদের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রিত৷ তারা কী করতে পারবেন আর কী পারবেন না- সেখানে সেগুলো স্পষ্টভাবে বলা আছে৷ আমাদের বন্ধুপ্রতীম পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদেরকে নিয়ন্ত্রিত আচার-আচরণের বাইরে গিয়ে কিছু করতে দেখা যায় না।
ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী, রাষ্ট্রদূতরা দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে কথা বলবেন, কাজ করবেন, উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সহযোগী হবেন। এটিই হচ্ছে মোটা দাগে কূটনৈতিক শিষ্টাচার। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ তাদের কোনোভাবেই নেই। অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা না বলা অবশ্যই নির্ধারিত ও পৃথিবীজুড়ে চর্চিত কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো, মতামত দেওয়া, ওই দেশের নির্বাচন কমিশনে গিয়ে বৈঠক করা কিছুতেই কূটনীতিকদের কাজ, বা দায়িত্ব নয়।
কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রে নিযুক্ত বিদেশি দূতরা কোথায় যাবেন, কার সঙ্গে কথা বলবেন বা কাকে আমন্ত্রণ জানাবেন- তা সেই দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানাতে হয়৷ দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে সেটা মাঝেমধ্যে মানতে দেখা যাচ্ছে না৷ আবারো বলছি, ঢাকায় নিযুক্ত কোনো কোনো দেশের কূটনীতিক সম্প্রতি এ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে যে ধরনের মন্তব্য করছেন, তা নি:সন্দেহে দৃষ্টিকটু ও আর্ন্তজাতিক শিষ্টাচারবর্জিত।
আমরা বহুপক্ষীয় সম্পর্ক, বিশ্বায়ন, প্রযুক্তির অগ্রসরতা, কূটনৈতিক নৈকট্য ও গণমাধ্যমের সার্বক্ষণিক নজরদারির যুগে বাস করছি। বিষয়টি কূটনীতিকদেরকে মনে রাখতে হবে। এ দেশের রাজনৈতিক দল, রাজনীতিবিদদের মধ্যে যারা বিদেশি রাষ্ট্রদূতকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন, তাদেরকেও মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পথ পাওয়া যায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের মাধ্যমে হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের কাছে নালিশ জানানোর মধ্যে গণতান্ত্রিক সমাধান নেই।
মূলত তাদের নালিশের কারণেই বিদেশিরা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাচ্ছেন। আর যে নির্বাচনকে ঘিরে এতো নালিশ, সেই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনের সাংবিধানিক ও আইনি ক্ষমতা ইসির আছে। নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য প্রয়োজন সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে সহাবস্থান।