শিশুকে অপহরণ করে ৪ বছর ধরে ‘ব্যবহার’, অবেশেষে গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানী ঢাকার গুলশান এলাকায় ৪ বছর আগে এক পথশিশুকে অপহরণ করা হয়। পরে তাকে গৃহকর্মী হিসেবে বাসায় আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন করার অভিযোগে আব্দুল্লাহ নামের এক স্টিল কারখানার মালিককে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-৩।

সোমবার দুপুরে র‌্যাব-৩ এর সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, র‌্যাব-৩, বিভিন্ন অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে ৩৭টি অভিযান চালিয়ে ৩৭ জন ভুক্তভোগী উদ্ধারসহ ৩৮ জন অপহরণকারী গ্রেপ্তার করেছে।

২০১৮ সালে এক হতদরিদ্র দিনমজুরের মেয়ে জীবিকার তাগিদে রাস্তায় ফুল ও কাগজের স্টিকার বিক্রি শুরু করে। প্রতিদিনের মতো ওই ভুক্তভোগী ফুল বিক্রি করতে রাস্তায় যায়। আর দিন শেষে সে আর বাসায় আসেনি। মেয়েকে বাসায় আসতে না দেখে তার বাবা-মা হন্যে হয়ে বিভিন্ন জায়গায় তার সন্ধান করতে থাকে। তাদের চেনা জানা সকল জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর একপর্যায়ে ভুক্তভোগী শিশুটির বাবা মা তাদের মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে গুলশান থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন। ওই সাধারণ ডায়েরি করার চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও কোন খোঁজ না পেয়ে তারা র‌্যাব-৩ এ একটি অভিযোগ করে।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, গুলশান থানায় নিখোঁজ ডায়েরির ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ ছায়া তদন্ত শুরু করে জানতে পারে যে, তাদের মেয়েকে অপহরণ করে আব্দুল্লাহ তার নিজের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে আটকে রেখে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করে আসছে। এরপর র‌্যাব-৩ এর একটি দল রবিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানে চার বছর আগে অপহরণ হওয়া আটক এবং গৃহকর্মী হিসেবে নির্মম নির্যাতনের শিকার এক অসহায় পথশিশুকে উদ্ধার করা হয়।

গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহর বরাত দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে লে.কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে গুলশান এলাকার আজাদ মসজিদের সামনে ফুটপাতে ভুক্তভোগী পথশিশুকে ফুল ও কাগজের স্টিকার বিক্রি করা অবস্থায় দেখতে পায়। সেখান থেকেই অপহরণকারী তাকে টার্গেট করে। পরে বেশ কয়েকদিন তাকে অনুসরণ করতে থাকে। এরপর একদিন বিকালে ফুল বিক্রি করার সময় অপহরণকারী ওই শিশুটিকে ডেকে তার নাম জিজ্ঞেস করে এবং তার ছেঁড়া জামা কাপড় দেখে নতুন জামা কাপড় কিনে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ওই শিশুটিকে একটি মার্কেটে নিয়ে যায়।

নতুন জামা কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনে দিয়ে ওই শিশুটিকে অপহরণকারী তার স্টিলের কারখানায় নিয়ে যায়। কারখানায় নিয়ে শিশুটিকে সাত থেকে আটদিন আটক রাখার পর তাকে স্থানীয় এক দালালের কাছে গৃহপরিচারিকা হিসেবে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রির জন্য বায়নাপত্র করে। কিন্তু কারখানায় থাকার ফলে খাবার এবং পর্যাপ্ত আলো বাতাসের অভাবে শিশুটি অসুস্থ হয়ে গেলে তার অবস্থা দেখে ওই দালাল শিশুটিকে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। শিশুটি অতিমাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে আব্দুল্লাহ শিশুটিকে তার নিজ বাসায় নিয়ে যায় এবং তাকে দিয়ে গৃহপরিচারিকার সব কাজকর্ম করাতে থাকে।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহ আরও জানায় যে, সে মূলত টাকার লোভে শিশুটিকে চড়ামূল্যে বিক্রির আশায় অপহরণ করেছিল। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী দামে বিক্রি করতে না পারায় তার নিজ বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজে ওই শিশুটিকে নিয়োজিত করেন।

শিশুটির জবানবন্দির বরাত দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব অধিনায়ক বলেন, অপহরণের পর আটক থাকাকালীন শিশুটি বাবা মার কাছে যাওয়ার জন্য আব্দুল্লাহর কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করলেও তাতে কোনো কাজ হয় না। যতদিন যায় শিশুটি তার বাবা মার কাছে যাওয়ার জন্য প্রতিনিয়তই কান্নাকাটি করে এবং তাদের বাসায় যারা নিয়মিত যাতায়াত করত তাদের অনেকের কাছেই শিশুটি তার বাবা মার বস্তির ঠিকানা দিয়ে সেই ঠিকানায় তাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করত। এসব দেখে গ্রেপ্তারকৃত আব্দুল্লাহ এবং তার স্ত্রী শিশুটিকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধামকি এবং ভয়ভীতি দেখায়। বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করলেই শিশুটির উপর নির্যাতনের পরিমাণ বেড়ে যেত। এভাবেই দুঃখ-কষ্টে নির্যাতনের শিকার হয়ে আব্দুল্লাহর গৃহপরিচারিকা হিসেবে ভুক্তভোগী শিশুটি চার বছর কাটিয়ে দেয়।

র‌্যাব অধিনায়ক বলেন, গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহ ২০০২ সাল থেকে খিলগাঁও এলাকায় স্টিলের ব্যবসায়ী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তিনি এক ছেলে ও একটি মেয়ে সন্তানের বাবা। তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। আব্দুল্লাহ প্রথমে স্টিলের দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরবর্তীতে তিনি নিজস্ব একটি স্টিলের কারখানা প্রতিষ্ঠা করে স্টিলের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন।

উদ্ধারকৃত ভুক্তভোগী চার বছর আগের অপহরণ হওয়ার সময় ১২ বছরের এক নাবালিকা শিশু ছিল। বর্তমানে তার বয়স ১৬ বছর। সে ১০ বছর বয়স থেকে গুলশানের বিভিন্ন রাস্তায় ফুল ও কাগজের স্টিকার বিক্রি করে বাবা মায়ের অভাব অনটনের সংসারে আর্থিকভাবে সহায়তা করত। তার বাবা সিটি করপোরেশনের পরিছন্নকর্মী হিসেবে কাজ করতেন এবং বর্তমানে তিনি রিকশাচালক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার মা গৃহকর্মী হিসেবে মানুষের বাসায় কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। ভুক্তভোগীর দুই ভাই-বোন রয়েছে, যারা তার মতই রাস্তায় ফুল ও স্টিকার বিক্রি করে থাকে।

শেয়ার করুন