পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত বিনিময় বন্ধ থাকার মধ্যে ঢাবিতে পাকিস্তানি সংগঠন ‘দাওয়াতে ইসলামীর’ আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজিত। এটা শুধু দুঃখজনক নয়, ধৃষ্টতাপূর্ণও। ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে সরাসরি জঙ্গিবাদে জড়িত থাকা বা মদদ দেওয়ার অভিযোগ নেই। তবে বিভিন্ন দেশে সংগঠনটির বেশ কয়েক অনুসারীর ধর্মের নামে বর্বর আচরণ বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে বিভিন্ন সময় আতঙ্কিত করে তোলে। অভিযোগের আঙুল উঠে সংগঠনটির বিরুদ্ধে।
সংগঠনটির কার্যক্রম ও উদ্দেশ্য একাধিক দেশের গোয়েন্দা সংস্থা খতিয়ে দেখছে। এনডিটিভি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, জি নিউজসহ ভারতীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম গত বছর জানায়, দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ ‘দাওয়াতে ইসলামীর’ ভারতে কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর সালমান তাসিরকে ২০১১ সালে ইসলামাবাদে দিনের বেলায় গুলি করে হত্যাকারী মুমতাজ কাদরি নিজেকে ‘দাওয়াতে ইসলামীর’ অনুসারী দাবি করেন।
২০০৭ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর হত্যাকাণ্ডের পর সালমান তাসিরকে হত্যার ঘটনাকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও আলোচিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে মনে করা হয়। পাকিস্তানে বিদ্যমান বিতর্কিত ধর্ম অবমাননার আইন রদ করার পক্ষে কথা বলায় সালমানকে হত্যা করেন মুমতাজ। ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের জের ধরে ২০১৫ সালে ফ্রান্সের ‘শার্লি এবদো’ পত্রিকার কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলায় অংশ নেওয়া পাকিস্তানি জঙ্গি জাহির হাসান মেহমুদ গ্রেপ্তার হলে জানা যায়, তিনিও ওই সংগঠনের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ।
গত বছরের মাঝামাঝি ভারতের রাজস্থানের উদয়পুরের একটি বাজারে দোকানের মধ্যেই গলা কেটে হত্যা করা হয় এর মালিক কানহাইয়া লালকে। খুনের ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয় নেটমাধ্যমে! ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির সাবেক মুখপাত্র নূপুর শর্মার ইসলাম ধর্মকে কটূক্তির পক্ষে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় কানহাইয়াকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন রিয়াজ আখতারি ও গউস মুহম্মদ। তারা নিজেকে পাকিস্তানি সংগঠনটির অনুসারী দাবি করেন।
পাকিস্তানে জন্ম নিয়ে ভারত, বাংলাদেশ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশে ‘দাওয়াতে ইসলামীর’ কার্যক্রম বিস্তৃত। গত ৩ জানুয়ারি ঢাবির আর সি মজুমদার মিলনায়তনে এদের অনুষ্ঠান আয়োজনের বিষয়টি অনেককে উদ্বিগ্ন করে তোলছে। কারণ, ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এক গবেষণায় উঠে এসেছে- ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা অংশ অনলাইনে উদ্ধুদ্ধ হয়ে ধর্মীয় উগ্র মতবাদের চর্চা করছেন।
অনলাইনে উগ্রতার চর্চা করে জঙ্গি তৎপরতায় অনেকে জড়িয়ে পড়েছেন। জঙ্গি ও ছদ্মবেশী জঙ্গিদের পরিচালিত ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলগুলো শিক্ষার্থীকে উগ্রপন্থার দিকে ধাবিত করছে। ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, আমেনা মহসিন ও দেলোয়ার হোসেন যৌথভাবে গবেষণাটি করেন। এর শিরোনাম- ‘বাংলাদেশ- ‘ফেসিং চ্যালেঞ্জেস অব র্যাডিকালাইজেশন অ্যান্ড ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম’।
ভারতের বিতর্কিত ইসলামী বক্তা জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে ‘জঙ্গিবাদে উৎসাহ যোগানোর’ অভিযোগ ওঠার পর ২০১৬ সালে তার ‘পিস টিভির’ সম্প্রচার বাংলাদেশে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় জড়িতদের মধ্যে অন্তত দুইজন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জাকির বক্তব্যে প্ররোচিত হন। সরাসরি জঙ্গিবাদে জড়িত না থাকলেও ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তির বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের অনেক তরুণের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা আছে। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে পরে। আমাদের দাবি, পাকিস্তানি ওই সংগঠনের এ দেশে চলমান কর্মকাণ্ডগুলো খতিয়ে দেখা হোক।
২০১৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাবির তখনকার উপাচার্যের সভাপতিত্বে সিন্ডিকেট সভায় পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্নের সিদ্ধান্ত হয়। একাত্তরে গণহত্যার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা ও গণহত্যা নিয়ে মিথ্যাচার বন্ধ না করা পর্যন্ত ঢাবির সঙ্গে পাকিস্তানের যোগাযোগ, সম্পর্ক ছিন্ন করে। এমন পরিস্থিতিতে ঢাবিতে ‘দাওয়াতে ইসলামীর’ অনুষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এক অধ্যাপকের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত ও মিলনায়তনও তার তত্ত্বাবধানে ভাড়া নেওয়া হয় বলে দেশের গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের পরও এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য। নিন্দনীয় এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী যথাযথ জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানাই।