বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় আজ বৃহস্পতিবারও সারাদিন থেমে থেমে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।কোনারপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী দুই সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় গোলাগুলি অব্যাহত থাকায় আতঙ্কিত সাধারণ রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নিতে চেষ্টা করছেন।
এরই মধ্যে কয়েক শতাধিক রোহিঙ্গা তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর কোনারপাড়া খোলা বিলে তাঁবু টানিয়ে অবস্থান করছেন। কিছু চলে গেছেন মিয়ানমারের কাঁটাতারের ভেতরে। পোড়া ঘরের বাসিন্দারা হতবিহ্বল হয়ে যে যারমতো আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তীব্র শীতে ঘরহারা মানুষগুলো শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। সবমিলিয়ে সেখানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
এমনটিই জানিয়েছেন শূন্যরেখায় অবস্থানরত ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ।
এদিকে, শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চলমান ঘটনার পর বাড়তি সতর্কতায় তুমব্রু ও ঘুমধুমের প্রধান ও উপসড়কে নিরাপত্তা জোরদার করেছে বিজিবি-পুলিশ। নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে যান চলাচল। স্থানীয়রা ছাড়া বাইরের কেউ চাইলেই এলাকায় ঢুকতে পারেননি বৃহস্পতিবার সারাদিন।
সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত ফোর্স বাড়িয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি, ঘুমধুম-তুমব্রুর বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান একে জাহাঙ্গীর আজিজ।
ঘুমধুম কোনাপাড়া ক্যাম্পের হাবিবা বেগম (৪৫) নামের এক রোহিঙ্গা বলেন, বুধবার (১৮ জানুয়ারি) থেকে আরসা ও আরএসও গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হলে প্রাণ বাঁচাতে অনেকেই মিয়ানমারে ঢুকে পড়েছেন। অনেকে তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। শূন্যরেখায় সংঘাতের পর দেওয়া আগুনে রোহিঙ্গাদের এক-তৃতীয়াংশ ঘর পুড়ে গেছে। প্রাণ বাঁচাতে সবাই দিগ্বিদিক পালিয়েছেন। আমার তিন সন্তান কোথায় আছে বৃহস্পতিবার সারাদিনই খবর পাইনি।
তুমব্রু বাজার এলাকার বাসিন্দা তরকারি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হোসেন (৫০) বলেন, ঘুমধুম কোনাপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বুধবার সকাল থেকে গোলাগুলির শব্দে স্থানীয়দেরও নিরাপদ স্থানে সরে যেতে হয়েছে। দফায় দফায় রোহিঙ্গাদের গোলাগুলি বৃহস্পতিবারও অব্যাহত ছিল। কোনাপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে আগুন জ্বলেছে তাতে বোঝা যায় অনেক ঘর পুড়ে গেছে। খবর পেয়েছি আশ্রয়হীন হয়ে শত শত রোহিঙ্গা মিয়ানমারের ভেতরে ঢুকে গেছেন।
স্থানীয় জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গোলাগুলির ঘটনায় তুমব্রু বাজারের অনেকেই দোকানপাট বন্ধ রেখেছেন। আগের চেয়ে বিজিবি ও পুলিশের টহল বেড়েছে। তুমব্রু বাজারসহ ঘুমধুম এলাকায় অকারণে স্থানীয়রাও চলাচল করতে পারছেন না।
বুধবারের গোলাগুলির পর অগ্নিসংযোগ এবং বৃহস্পতিবারও গোলাগুলির ঘটনা অব্যাহত ছিল বলে জানান ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ কে জাহাঙ্গীর আজিজ।
তিনি বলেন, তবে কারা গোলাগুলি করছে সেটা নিশ্চিত নই। গোলাগুলিতে আতঙ্কিত ও আগুনে ঘরহারা রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা খুঁজতে ক্যাম্প ছেড়ে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছেন। অনেকে পাহাড় কিংবা আশপাশের খোলা জায়গায় তাঁবু টানিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। বুধবার ভোর থেকে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডের কোনারপাড়া ক্যাম্পের ভেতর এবং মিয়ানমার সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার ওপার থেকে গোলাগুলি হচ্ছিল।
গোলাগুলির ঘটনায় সীমান্তে বসবাসরত অনেকে গৃহপালিত পশুসহ অন্যত্র সরে গেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোমেন শর্মা বলেন, ঘুমধুম-তমব্রু সীমান্তে শূন্যরেখায় মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি করে সীমান্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, বিজিবিসহ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার নেই। তারপরও সীমান্তের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা সতর্ক অবস্থানে আছে।
ইউএনও আরও বলেন, ঘটনার পর কোনারপাড়া ক্যাম্প ছেড়ে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আর কিছুসংখ্যক মিয়ানমারের ভেতর চলে গেছে বলে জেনেছি। যারা বাংলাদেশের দিকে এসেছেন, তাদের অধিকাংশ নারী, বৃদ্ধ ও শিশু। চলমান অস্থিরতা বন্ধ হলে তাদের ফেরত পাঠানো হবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার ঢাকার এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আমি সবসময় বলেছি, একসময় রোহিঙ্গা ক্যাম্প আমাদের জন্য বিষফোঁড়া হবে। কারণ রোহিঙ্গারা তাদের সবকিছু ফেলে এখানে এসেছে। তারা যেকোনো যেকোনো প্রয়োজনে, প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে যেকোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে।
মন্ত্রী আরও বলেন, রোহিঙ্গারা তাদের ক্যাম্পের ভেতরে ইয়াবার ব্যবসা করে। নিজেরা নিজেরা গোলাগুলি করছে, প্রতিদিন তারা মারামারি করছে। তমব্রু নামক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তারা ডিজিএফআইয়ের এক কর্মকর্তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। গতকাল থেকে সেখানে গোলাগুলি ও বাড়িঘর পোড়ানো হয়েছে।
বুধবার ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনার পর এমএসএফের হাসপাতাল থেকে এক রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ১২ বছরের এক শিশুসহ আরও দুজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
নিহত হামিদ উল্লাহ বালুখালী ক্যাম্প, আহতরা মুহিব উল্লাহ টেকনাফের জাদিমুড়া ক্যাম্প-২৬ ও শিশু মোহাম্মদ হোছন ঘুমধুম জিরো পয়েন্টের বাসিন্দা। তবে, বালুখালী ক্যাম্পের বাসিন্দা হামিদ ও টেকনাফ জাদিমুড়া ক্যাম্পের মুহিব জিরো পয়েন্টে কেন, সে বিষয়ে এখনো বিস্তারিত জানা যায়নি।
ময়নাতদন্তের পর হামিদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। বাকি দুজন এখনো চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রাখাইন রাজ্যে সেদেশের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। এরআগে এসেছিল আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ।
ওইসময় ছয় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের কোনারপাড়া খালের দক্ষিণে শূন্যরেখায় বসতি শুরু করেন। এখান থেকে কয়েক গজ দূরত্বে মিয়ানমার সীমান্ত কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নজরদারিতে কাঁটাতারের বাইরে পাহাড়চূড়ায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) একাধিক চৌকি স্থাপন করেছে।
তুমব্রুর কোনারপাড়া শূন্যরেখা ক্যাম্পে ৬২১ পরিবারে চার হাজার ২৫৪ রোহিঙ্গা বাস করছিলেন বলে জানিয়েছেন ক্যাম্পের মাঝি (নেতা) দিল মোহাম্মদ।