বিয়ের আগে কারো মেয়ে, কারো বোন। আবার বিয়ের পর কারো স্ত্রী, কারো মা। জীবনচক্রের এসব পরিচয় অনেক সময় নারীর নিজের সত্তাকে আড়ালে ফেলে দেয়। নারী-পুরুষের প্রবল ভেদাভেদের ও কুসংস্কারে হাবুডুবু খাওয়ার এ সমাজে কোনো কোনো নারী এসব সম্পর্কের পরিচয়ের মধ্যে কাটিয়ে দিতে বাধ্য হন পুরোটা জীবন। তার জন্য অস্তিত্বসংকট তৈরির পুরুষতান্ত্রিক এ মানসিকতা সমাজের গভীরে গেঁথে রয়েছে অজস্র বছর ধরে। তবু অনেক নারী প্রচলিত ধ্যানধারণা ভেঙে ভিন্ন ভিন্ন জগতে কাজের মাধ্যমে নিজ পরিচয়ে জ্বলজ্বল করছেন। লড়াই করে কেউ কোনো অঙ্গনে নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করতে পারলে পুরুষতন্ত্রও তা মুছে দিতে পারে না।
কারণ, সেখানে নারী নিজের সত্তায় উজ্জ্বল। নিজের চিরন্তন সত্তা থাকায় অন্যের পরিচয়ে পরিচিত হওয়া তার জন্যে অপমানজনক। নারীর নামের সঙ্গে তার মর্যাদার বিষয়টিও যুক্ত। কেউ তা হারিয়ে ফেলতে চান না। প্রত্যেক নারীর একক সত্তার সঙ্গে নিজ নামে পরিচিত হওয়ার অধিকার আছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে পেশির কোনো মূল্য নেই, এখানে কোনো সত্তার বুদ্ধিদীপ্ততাই মুখ্য। দুঃখজনক হলেও সত্য, আধুনিক এ সময়ে সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশে আইনি সুরক্ষাসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও নারীর অবদান ও সামর্থ্য খাটো করে দেখার প্রবণতা রয়ে গেছে সমাজে।
নারীকে নিজের সত্তায়, বা পরিচয়ে উজ্জ্বল হতে প্রথম কাজটি হবে তার ভেতর আত্মবিশ্বাস তৈরি করা। সেই কাজটা করবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানার বই ‘নারীসত্তার অন্বেষণে’। নারীর টিকে থাকার তাগিদের লড়াইয়ে, হার না মানার সংগ্রামে সাহস জোগাবে। নিজ নামে পরিচিত হতে নারীর মধ্যে আকাঙ্ক্ষা তৈরিতে ও তার নিজস্ব পরিচয়কে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরিতে নিঃসন্দেহে প্রেরণাদায়ক হবে বইটি। প্রচলিত বৈষম্য, নিপীড়নের মধ্যেও নারীরা কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, তা দক্ষ গবেষক ও কথাকারের মতো স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বইটিতে তুলে ধরেছেন।
বইটিতে বিভিন্ন নারীর গল্প আছে। এসব উপস্থাপনায় মৌলিকত্বের সঙ্গে স্নিগ্ধা রেজওয়ানার স্বকীয়তাও আছে। শৈশব থেকে বৈষম্যের শিকার নারীর গল্প, কীভাবে সদ্য বিবাহিতা নারী নিজেকে নতুন সম্পর্কে খুঁজে পান, কীভাবে তালাকপ্রাপ্ত নারী তার জীবন পুনর্গঠন করেন ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণায় মধ্যবিত্তদেরকে বেছে নেওয়া হয়েছে। নারীর সত্তা নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়া, লিঙ্গীয় সর্ম্পকে তার শরীর, যৌনতা, মাতৃত্ব, শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক সম্পর্ক ও মধ্যবিত্তের চৈতন্য কীভাবে তার সত্তা গঠনে সক্রিয় করে তোলে, মধ্যবিত্ত নারীর সত্তার সঙ্গে তার আত্মগত সচেতনতা এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিসরে নির্মিত এক ধরনের চেতনাবোধের গভীর বিশ্লেষণ এ বইয়ে ঠাঁই পেয়েছে। নারীর সত্তা নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণের প্রেক্ষাপট এ বইয়ের মূল সুর।
লেখকের মূল যুক্তি- নারীর আত্মগঠন একটি জটিল ও চলমান প্রক্রিয়া। যা সমাজের মনোভাব, নিয়ম ও প্রত্যাশার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। নারীর পরিচয় গঠন একটি রৈখিক প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি গতিশীল। ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। বইয়ের একটি অংশে লেখিকা তুলে ধরেছেন কীভাবে নারীর শরীর, যৌনতা, মাতৃত্ব তার সত্তার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং কীভাবে তিনটি বিষয় যে কোনো প্রেক্ষাপটে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। এবারের একুশের বইমেলা সামনে রেখে স্নিগ্ধা রেজওয়ানার ‘নারীসত্তার অন্বেষণে’ বইটি ছাপা হয়েছে ঢাকার ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে। এর প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। বইটি সু-গবেষণা। সূক্ষ্মভাবে লেখা।
ড. স্নিগ্ধার লেখাও চিত্তাকর্ষক। তাঁর বিশ্লেষণ উপলব্ধিমূলক। আমার মনে হয়, বইটিতে তাঁর ফোকাস একটু বেশি একাডেমিক। বইটির শিরোনাম নারীর সারমর্ম অন্বেষণ করা সত্ত্বেও সাধারণ পাঠক হিসেবে মনে করি, এটি বেশ দরকারি। বইটি সাধারণ পাঠকদেরকেও উপকৃত করবে। নারীদেরকে করবে আত্মপ্রত্যয়ী। আবারো বলি, দেশের সমাজব্যবস্থায় বা আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর পরিচয় সংকটে। প্রথাগত মানসিকতা পরিবর্তন করতে যেসব দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দরকার, যা পরিবর্তনের পথে সহায়ক হব, পাঠকরা আলোচ্য বইটিতে সেসব পাবেন।
লেখক: শিক্ষক, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অফ সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া।