টানা তিন বছর পর করোনা মহামারির দাপট কমে যাওয়ায় অর্থনীতির চাকা পুনরায় সচল হওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু যুদ্ধ সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে দিয়েছে এবং মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে আকাশচুম্বী। ইউরোপের নীতিনির্ধারকরা ধারণা পোষণ করেন ২০২৩ সালে হয়তো অর্থনীতিতে পুরোনো চেহারা ফিরে আসবে। মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বলতে গেলে ইউরোপের অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল হয়নি। বরং দুর্ভাগ্যবশত বিষয়টি আরও কুৎসিত আকার ধারণ করছে।
যদি ইতিবাচকভাবে ধরা হয়, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ও জ্বালানি সংকটের ধাক্কায় ইউরো জোন উল্লেখযোগ্যভাবে স্থিতিস্থাপক হয়ে পড়ে। যুদ্ধ শুরুর পর গত গ্রীষ্মে গ্যাসের দাম বেড়ে যায়, যদিও এখন সস্তা। সরকারগুলোকে জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে বাধ্য করা হয়নি যেমনটি প্রথমে আশঙ্কা করা হয়েছিল। তবে অসময়ে উষ্ণ আবহাওয়া তাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে রেকর্ড পরিমাণ ১০ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছায় যা এখন হ্রাস পাচ্ছে।
ধারণা করা হয়েছিল জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় শিল্পখাতেও ধস নামবে। জার্মানিতে জ্বালানি নির্ভর কারখানাগুলোর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে উৎপাদন পঞ্চমাংশ হ্রাস পেয়েছে। কারণ আমদানি নির্ভরতা অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে। তবে প্রাক-মহামারি প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বছরের শেষ নাগাদ সামগ্রিকভাবে উৎপাদন মাত্র ৩ শতাংশ কমে। আইএফও বিজনেস ক্লাইমেট সার্ভে মাসিকভিত্তিতে জার্মানির ব্যবসার পরিবেশের অবস্থা পরিমাপ করে। তারা বলছে, অবকাঠামোখাত সংশ্লিষ্টরা করোনা মহামারির আগের মতো আশাবাদি হতে পারে।
যদিও ২০২২ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে জার্মানির অর্থনীতি কিছুটা সঙ্কুচিত হয়েছে। তবে ইউরো জোন মন্দার আশঙ্কাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। ইউরোপীয় কমিশনের সর্বশেষ পূর্বাভাস বলছে, ব্লকটি এই প্রান্তিকেও সংকোচন এড়াবে। সম্প্রতি সমীক্ষাও এই পূর্বাভাসকে সমর্থন করছে।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে মানুষ কাজে সক্রিয় থাকে। ২০২২ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে এই ব্লকজুড়ে কাজের সংখ্যা আবার বেড়েছে। ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়ার পর বেকারত্বের হার সর্বনিম্ন এখন। জরিপে উঠে এসেছে, সংস্থাগুলো নতুন কর্মীর সন্ধান করছে। চাকরি করার ফলে মানুষ খরচও করে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধি সত্ত্বেও, ২০২২ সালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকে ব্যবহারের পরিমাণ ৫০ শতাংশ পয়েন্ট অবদান রেখেছে।
মরগান স্ট্যানলি হলো একটি আমেরিকান বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক পরিষেবা সংস্থা। এটির ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক বলছে, জ্বালানি সংকট অনেক সময় ভোক্তাদের প্রভাবিত করতে সময় নেয়। এর মধ্যে সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পরিবারগুলোকে ব্যয় করতে সহায়তা করে।
এখন প্রশ্ন হলো তারা কতদিন খরচ করতে থাকবে। ২০২২ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে পরিবারগুলোর কেনাকাটা কঠিন হওয়া শুরু করেছে। অস্ট্রিয়া ও স্পেনের জিডিপি পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যায়, ত্রৈমাসিক বৃদ্ধির হার শতকরা পয়েন্টে টেনে এনেছে। আগের মাসের তুলনায় ডিসেম্বরে ইউরো জোনে খুচরা বাণিজ্য ২ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। সরকারের সহায়তা ও বেধে দেওয়া দর এবছর প্রত্যাহার করা হবে। ফলে ব্যয়ে জটিলতা বাড়তে পারে।
মূল্যস্ফীতি এখনো স্থির। কমিশনের এক কর্মকর্তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘ইইউতে আমাদের কাছে ২৭টি ভিন্ন উপায় রয়েছে যাতে পাইকারি জ্বালানির দাম গ্রাহকদের কাছে দেওয়া হয়। এর পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। কিছু পণ্যের দামে চাপ এখনো আছে। যেমন জার্মানিতে দেখা যাচ্ছে, জানুয়ারিতে জ্বালানির দাম ডিসেম্বর থেকে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে।েএমনকি যদি পাইকারি মূল্য বর্তমান নিম্ন স্তরে থাকে, তবে গৃহস্থালীর পণ্যের দাম অনিয়মিত হয়ে পড়তে পারে।
ইউরোপের শক্তিশালী চাকরির বাজার মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে। বৃদ্ধদের অবসর নেওয়ার কারণে উচ্চমূল্য ও শ্রমের ঘাটতির আরও অবনিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। নেদারল্যান্ডসে মজুরি জানুয়ারিতে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। এক বছর আগের তুলনায় ২০২২ সালে মাত্র ৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ২ দশমিক ১ শতাংশ বাড়ার পর। জার্মানির বিভিন্ন সেক্টরের ইউনিয়নগুলো আরও ধর্মঘটের হুমকি দিচ্ছে ৷ তারা বেতন ১০ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনও করছে।
একটি নিয়োগের ওয়েবসাইটের ডেটা থেকে দেখা যায় ইউরো অঞ্চলে মজুরি অন্তর্নিহিত মূল্যস্ফীতি অনুসরণ করে। এতে স্বাভাবিক হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ভোক্তা-মূল্য সূচকে, খাদ্য ও জ্বালানির মূল্য জানুয়ারি থেকে ৭ শতাংশ বেড়েছে।
ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের কাছে সুদের হার উচ্চ রাখার বিকল্প নেই। গ্রীষ্মেও বাজার দর আড়াই শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইউরো জোন হয়তো এখন পর্যন্ত মন্দা থেকে রেহাই পেয়েছে, কিন্তু একগুঁয়ে মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদের হার ও দুর্বল অর্থনীতি সুখকর নয়। আইএমএফ ২০২৩ সালে ইউরোজোনে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। কমিশন পূর্বাভাস দিয়েছে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। অপরদিকে, আমেরিকা এখনো একগুঁয়ে মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি। এ ছাড়া চীনের পুনরায় সচল হওয়া অর্থনীতিও এই ব্লকটিকে খুব বেশি প্রভাবিত করছে না।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট