একটি ভাষণই পরাধীন জাতিকে অমূল্য স্বাধীনতা এনে দেয়

মোনায়েম সরকার

মোনায়েম সরকার
মোনায়েম সরকার

পৃথিবীতে বহু রাজনৈতিক নেতার আবির্ভাব হয়েছে । তারা অনেক ভাষণও দিয়েছেন। সব নেতা যেমন নিজের দেশের গণ্ডি পেরিয়ে অন্য দেশের মানুষের কাছেও প্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি, তেমনি সব নেতার কোনো একটি ভাষণও পৃথিবীজোড়া খ্যাতি পায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আব্রাহাম লিংকনের নাম শোনেননি এমন রাজনীতি সচেতন মানুষ কি পৃথিবীর কোনো প্রান্তে আছেন?

আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণও তেমনি পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে আছে। আমরা বাঙালিরা, বাংলাদেশের মানুষেরাও অহংকার করে বলতে পারি, আমাদেরও এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি দুনিয়া জুড়েই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো যার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ একটি ভাষণ দিয়েছিলেন, যে ভাষণ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ১৮ মিনিটের ভাষণটি যেমন ছিল উদ্দীপিত ও উদ্দীপনামূলক, তেমনি ছিল দিকনির্দেশনামূলকও। একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাকে ওই ভাষণ দিতে হয়েছিল। ভাষণে একদিকে ছিল জাতির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে স্বাধীনতার মন্ত্রণা, আবার কেউ যেন তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে সেদিকে নজর রেখে ভারসাম্যপূর্ণ ও সুচিন্তিত শব্দ চয়ন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি। তার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো কি না বলা মুশকিল। তিনি মানুষের মধ্যে থেকে ওঠে আসা একজন নেতা। তিনি সারাজীবন লড়েছেন বঞ্চনা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে। পরাধীন বাঙালি জাতিকে তিনিই দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্ন। শুধু স্বপ্নই দেখাননি, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বিশ্বসভায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন অসংখ্য ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু যে ভাষণ দিয়ে তিনি নিপীড়িত বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, সেই ভাষণটি তিনি দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে।

বলা হয়ে থাকে, ৭ মার্চের ভাষণদানকালে রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষ লোক উপস্থিত হয়েছিল। মাত্র আঠারো মিনিটের জ্বালাময়ী ভাষণ শুধু সেদিনের মুক্তিপাগল মানুষকেই মুক্তির জন্য উদ্বুদ্ধ করেনিÑ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সামরিক কর্তা মেজর জিয়া, মেজর শফিউল্লাহসহ সবাই স্বীকার করেছেন যে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল তাদের কাছে স্বাধীনতার গ্রিন সিগন্যাল। ৭ মার্চের ভাষণ শুধু একাত্তরের প্রেরণা ছিল না পরবর্তীকালে নতুন প্রজন্মকেও দারুণভাবে নাড়া দেয়। এখনও তার ভাষণ তরুণ প্রজন্মকে শৃঙ্খল ভাঙার প্রেরণা জোগায়।

এ প্রসঙ্গে আমার দুটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। প্রয়াত জাসদ নেতা মঈনুদ্দিন খান বাদলের ছেলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে এতটাই আবেগতাড়িত হয়ে গিয়েছিল যে, সে তার বাবাকে (মঈনুদ্দিন খান বাদল) বলেছিল, ‘বাবা তোমরা কি এই লোকটার বিরুদ্ধে গিয়ে নতুন দল জাসদ করেছিলে? আই হেট টু টক টু ইউ ফাদার’- এ কথার সত্যতা জানার জন্য আমি বাদলের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ঘটনাটা সত্য। প্রয়াত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের লেখায়ও এই ঘটনাটি পড়েছিলাম।

আরেকটি ঘটনাও ঠিক একই রকমের। আমাদের বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে আনান নামের এক কিশোর মাঝে মাঝে আসে। সে ভালোবেসে আমাকে ‘বন্ধু’ বলে ডাকে। একদিন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে সে তার মাকে বলে, ‘মা জান বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আমার রক্ত গরম হয়ে যায়; আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে।’ যে-ভাষণের সংগ্রামীবাণী নাবালক শিশুকেও আলোড়িত করে, সেই ভাষণ পরাধীন মানুষকে শেকল ভাঙার শক্তি জোগাবে- এটাই তো স্বাভাবিক।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের নেতা। তিনি মানুষের দুঃখকষ্ট বুঝতেন বলেই তাদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন। কয়েকদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতায় যেসব সাধারণ মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের কথা মনে ছিল বলে বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকাপয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়ে দেবেন’।

জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তিনি যে নির্দেশ দেওয়ার বৈধ অধিকার পেয়েছেন, হয়তো সেটা আবারও মনে করিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ দেবে না’।

বিভেদ-বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়’।

রেসকোর্স ময়দানে সমবেত লাখ লাখ মানুষ তখন কিছুটা যেন চঞ্চল। কারণ সবার আগ্রহ তো বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার। দলের মধ্যেও তরুণদের চাপ ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা যেন বঙ্গবন্ধু ওই সমাবেশ থেকেই দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন, তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে কী পরিণতি হতে পারে। সেনাবাহিনী তৈরি ছিল হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়ার জন্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এটাও জানতেন যে তিনি যদি মানুষের প্রত্যাশার প্রতিধ্বনি না করেন তাহলে তারা হতাশ হবেন। সে জন্য তিনি কৌশলের আশ্রয় নিলেন।

শাসকগোষ্ঠীর চোখে ধুলো দিয়ে জনতার উদ্দীপনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ভাষণের একেবারে শেষে এসে শোনালেন সেই মহাকাব্যিক বাণী, ‘যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে-শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা’।

উচ্ছ্বসিত জনতা পেয়ে গেল স্বাধীনতার ঘোষণা। জ্যাকব এফ ফিল্ড ২০১৩ সালে গ্রেট ব্রিটেন থেকে একটি বই প্রকাশ করেন ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস’ (We shall fight on the Beaches) নামে। এই বইটির উপশিরোনাম হলো ÔThe speeches that inspired historyÕ. এই বইয়ে জ্যাকব এফ. ফিল্ড বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের ৪১টি ভাষণ সংকলিত করে ইংরেজিতে প্রকাশ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ অব্দ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বনেতৃবৃন্দের ঐতিহাসিক ভাষণগুলো এতে স্থান পেয়েছে। বইটির নামকরণ করা হয়েছে ১৯৪০ সালে প্রদত্ত উইনস্টন চার্চিলের বিখ্যাত ভাষণের শিরোনাম অবলম্বনে। এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি প্রায় ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো ভাষণ এতগুলো ভাষায় অনূদিত হয়েছে কি-না, এই মুহূর্তে তা আমার জানা নেই। পৃথিবীর এতগুলো ভাষায় যে ভাষণ অনূদিত হতে পারে সে ভাষণের গুরুত্ব কতখানি তা সহেজই অনুমেয়।

৭ মার্চের সংক্ষিপ্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রাম ও প্রত্যাশার কথা যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেছিলেন। মাত্র কয়েক মিনিটের একটি ভাষণে ইতিহাস এবং ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে এমন প্রাঞ্জল ও আবেগময় ভাষায় পৃথিবীর আর কোনো নেতা তুলে ধরতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। আমরা আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতা বলি আর মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিমের’ কথাই বলি, পৃথিবীর কোনো নেতার ভাষণই বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মতো এত আলোড়ন আর স্বাধীনতার স্বপ্ন তৈরি করতে সক্ষম হয়নি।

এমন ইতিহাসসমৃদ্ধ কাব্যিক ভাষণ রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দেওয়াই সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে আর কোনো বাঙালির ভাষণ বিশ্ববাসীর এত মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। বঙ্গবন্ধুই সেই বাঙালি নেতা, যিনি একটি ভাষণেই একটি পরাধীন জাতিকে অমূল্য স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন।

মাত্র পঞ্চান্ন বছরের জীবনে বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার জন্য বঙ্গবন্ধু অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। যেগুলো একজন বাঙালির জন্য অত্যন্ত অহংকারের ও গর্বের। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরাধিকারী হিসেবে আমাদেরও কিছু করণীয় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি।

আজ বাঙালির ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ ২১ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার যে আন্দোলন সেই আন্দোলনের একজন পথিকৃৎ নেতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলা ভাষা ও বাঙালির অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিরাপোস যোদ্ধা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সর্বপ্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বা ‘বিশ্বের স্মৃতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। ৩০ অক্টোবর, ২০১৭ তারিখ প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দফতরে সংস্থাটির মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এক বিজ্ঞপ্তিতে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্বালাময়ী ওই ভাষণটিকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে ঘোষণা করেন।
০৬ মার্চ, ২০২৩

লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।

শেয়ার করুন