জাপানে টোকিওর একটি শহরের প্রথম নারী মেয়র সাতোকো কিশিমোতো। ২০২২ সালের জুনে টোকিওর সুগিনামি শহরের ইতিহাসে তিনি প্রথম নারী মেয়র নির্বাচিত হন। সাবেক পরিবেশকর্মী ও ডেমোক্রেসি আইনজীবী ৪৮ বছর বয়সী সাতোকো মাত্র ২০০ ভোটে রক্ষণশীল ক্ষমতাসীনকে পরাজিত করেন। কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এই জয় সবার জন্যই বিস্ময়ের ছিল।
সাতোকো টোকিওর প্রধান ২৩টি জেলার মাত্র ৩ জন নারী মেয়রের একজন। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তিনি দেশের পুরুষশাসিত রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করার অঙ্গীকার করেন। সাতোকো কিশিমোতো বলেন, রাজনীতিতে নারীদের এই নিম্নপ্রতিনিধিত্বকে জাতীয় সংকট হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ৭৫ বছর ধরে নারীদের প্রতিনিধিত্ব প্রায় একই অবস্থায় আছে। এটা আশ্চর্যজনক।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপান। তবে লিঙ্গব্যবধানের সূচকের ক্ষেত্রে এর অবস্থান অনেক নিচে। গত বছরের জুলাই মাসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, লিঙ্গব্যবধানের সূচকে ১৪৬টি দেশের মধ্যে জাপানের অবস্থান ১১৬। খবর বিবিসির।
জেন্ডার ইস্যুতে জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও জাপানের অবস্থান খুব একটা ভালো নয়। দেশটিতে কোনো দিন নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। আর বর্তমান মন্ত্রিসভায় মাত্র দুজন নারী সদস্য আছেন। দেশটির রাজনীতিতে যেসব নারী আছেন, তারা প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানি ও লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
সাতোকো বলেন, আমি যখন কথা বলি, মানুষ শোনেন। কিন্তু মানুষকে এত সহজে বিশ্বাস করানো কঠিন। তিনি মূলত মানুষ বলতে তার সঙ্গে কাজ করা পুরুষ সহযোগীদের বুঝিয়েছেন। তার নিজের জেলায় মেয়র ছাড়া জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক পদের অধিকাংশই পুরুষের হাতে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈচিত্র্য, লিঙ্গসমতার মতো বিষয়গুলোকে বয়স্কদের রাজনীতি ও তরুণদের ক্লাব রাজনীতির মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এটা তার ও সহকর্মীদের জন্য হতাশার বিষয়। তিনি আরও বলেন, আমি রাজনীতি নিয়ে সত্যিই বিতর্ক করতে চাই। কিন্তু সিটি কাউন্সিলে সমালোচনা ও ব্যক্তিগত আক্রমণে (অনেক) সময় নষ্ট হয়।
এ সমালোচনার বেশিরভাগই সাতোকোর লিঙ্গভিত্তিক যোগ্যতা নিয়ে। যদিও এসব বিষয়ে তার প্রাসঙ্গিক কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। গত ২০ বছর তিনি ইউরোপে ছিলেন। সাতোকো কিশিমোতো এটা অকপটে স্বীকার করে বলেন, তিনি বহিরাগত। কিন্তু এটাই তার শক্তি।
টোকিওর মাচিদা জেলার কাউন্সিল সদস্য তামোমি হিগাশি। সম্প্রতি তিনি দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বলেন, শারীরিক হয়রানির কারণে আমি সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুর দিকে আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হয়েছিলাম। এতে খুব আঘাত পেয়েছি।
তামোমি হিগাশি আরও বলেন, বয়স্ক পুরুষদের দ্বারা অপমান করা হচ্ছে। (পুরুষ) আমার খুব কাছে এসে বক্তব্য বাধাগ্রস্ত করছে। মধ্যরাতে পানীয় খেতে যেতে বলা হচ্ছে। তখন আমি সত্যিই পুরুষশাসিত সমাজ অনুভব করেছি। মূলত এটা ছিল আমার জন্য জেগে ওঠার আহ্বান।
স্থানীয় নারী রাজনীতিক, আইনজীবী ও গবেষকেরা রাজনীতিতে থাকা নারীদের জন্য হয়রানি পরামর্শকেন্দ্র নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করেছেন। এ দলে তামোমি হিগাশি যোগ দিয়েছেন। তাদের প্রত্যাশা, তাদের গোপন অনলাইন সেশনগুলো নারীদের রাজনীতিতে আসার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেবে।
ওয়েবসাইটের একজন প্রতিষ্ঠাতা মারি হামাদা বলেন, যদিও অনেক জরিপে নারী রাজনীতিকদের হয়রানির ব্যাপক তথ্য পাওয়া যায়। তবে এর সঠিক সংখ্যা পাওয়া খুব কঠিন। কারণ, অধিকাংশ নারীই এসব বিষয়ে নিয়ে কথা বলতে চান না। জাপানে রাজনীতিকদের বিশেষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে তাদের হয়রানি সহ্য করতে বলা হয়।
জাপানের সংবাদ সংস্থা কিয়োদোর সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নারী রাজনীতিক ও নেতাদের তাদের পুরুষ সহযোগীদের তুলনায় লিঙ্গবৈষম্য ও যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
নারীদের রাজনীতিতে আসতে উৎসাহিত না করায় দেশটির সরকার প্রায় সময় সমালোচিত হয়েছে। কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন যে, পুরুষশাসিত মন্ত্রিসভা ও ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) মূলত এই সমস্যার জন্য দায়ী।
জাপানে ১৯৫৫ সাল থেকে এলিডিপি প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবেই দেশটির ক্ষমতায় আছে। ২০২১ সালে দলটি পাঁচজন নারী আইনপ্রণেতাকে বোর্ড মিটিংয়ে যোগদানের অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব করে। তবে শর্ত ছিল, বোর্ড মিটিংয়ে নারী সদস্যেরা কোনো কথা বলতে পারবেন না।