৭ মার্চের ভাষণ বিকৃতি এবং সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
ফাইল ছবি

গত ৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অমূল্য সম্পদ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে জাতিসংঘ একটি ঐতিহ্যবাহী ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকেই বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, যে ভাষণে বঙ্গবন্ধুর শেষ কথা ছিল ‘জয় বাংলা’। এখন বিশ্ব সংস্থা যদি দেখতে পায় যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা কেন্দ্রের প্রধান বলেছেন ভিন্ন কথা, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলে ভাষণ শেষ করেছিলেন, তাহলে এটি নিয়ে জাতিসংঘেই নতুন জল্পনার সূত্রপাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নতুন করে নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। শুধু তা-ই নয়, গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে কর্মরত কোনো ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিকৃত করে কোনো বই প্রকাশ করলে সেই বিকৃতি সারা জীবনের জন্য দলিল হয়ে থাকবে, যদি না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মিথ্যা স্বীকার করে বিকৃত বক্তব্য না শোধরান। সে অর্থে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিকৃত ভাষণ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকবে।

বেশ কিছু সময় থেকেই একটি মহল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিতর্কিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এই মহলটি কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে দিয়ে এমন কথা ছড়িয়েছে যে বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা বলার পর ‘জয় পাকিস্তান’ বলে তাঁর ভাষণ শেষ করেছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রমাণ করা যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি।

universel cardiac hospital

যাঁরা এমন দাবি করেছেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার এবং ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তবে এই বিভ্রান্তি ছড়ানো শুরু করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা।

উপরোল্লিখিত ব্যক্তিদের মধ্যে বিচারপতি হাবিবুর রহমান এবং এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের দাবি তাঁরা নিজেরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনেননি, বরং অন্য লোকের কাছ থেকে শুনেছেন যে বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলে তাঁর ভাষণে ইতি টেনেছেন। কিন্তু তৃতীয় ব্যক্তি অর্থাৎ ড. ইমতিয়াজ তাঁর পুস্তক ‘হিস্টোরাইজিং ৭১ জেনোসাইড’ বইয়ের ৪০ পৃষ্ঠায় দাবি করেছেন যে তিনি নিজে ’৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত থেকে (তাঁর ভাষায়) শেখ মুজিবের পুরো ভাষণটি শুনেছেন এবং শেখ মুজিব (তাঁর ভাষায়) জয় পাকিস্তান বলে ভাষণ শেষ করেছেন। ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জেনোসাইড সেন্টার নামে একটি ইউনিটের প্রধান, আরো লিখেছেন যাঁরা দাবি করেন যে শেখ মুজিব (তাঁর ভাষায়) এমনটি বলেননি, তাঁরা শ্রবণজনিত অসুবিধার কারণেই শেষ বাক্যটি শুনতে পাননি। ড. ইমতিয়াজ তাঁর কথিত বইটি লিখেছিলেন ২০০৯ সালে। কিন্তু গত দুই মাস আগে বইটি সবার নজরে আসে। ড. ইমতিয়াজ লিখেছেন, তিনি তাঁর এক পাকিস্তানি বন্ধুর অনুরোধে বইটি লিখেছেন। সাবা খাট্টাক নামের এই নারী পাকিস্তানের ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট’-এর সাবেক পরিচালক।

বিচারপতি হাবিবুর রহমান পরবর্তী সময়ে স্বীকার করেছেন যে তিনি ‘অন্যদের’ থেকে যা শুনেছিলেন, তাতে ভুল ছিল। এ কথা বলে ভুল স্বীকার করে নিয়ে তাঁর আগের দাবি থেকে সরে গিয়েছেন। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের দাবির পেছনে যে রাজনৈতিক অভিসন্ধি কাজ করেছে, সেটি তাঁর পরবর্তী স্বীকারোক্তি থেকেই পরিষ্কার হয়েছে। তিনি তাঁর স্বীকারোক্তিতে বলেছেন যে মইদুল ইসলাম নামের এক রাজনীতিবিদের কথায় তিনি এমনটি লিখেছিলেন। তিনি ভুল ও মিথ্যাচার স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এর কিছুকাল পরে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ‘মিথ্যাচারী’ হিসেবে কলঙ্কতিলক মাথায় নিয়ে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ দেশের মানুষ যাকে আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতেন, স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের খপ্পরে পড়ে তাঁর ভাগ্যে ঘটেছিল ঠিক তার উল্টোটি। ড. ইমতিয়াজ অবশ্য তাঁর মিথ্যাচার স্বীকার করেননি এবং জাতির কাছে ক্ষমাও চাননি, যার অর্থ তিনি তাঁর দাবিতে অটল রয়েছেন। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা পাকিস্তানপন্থী শিবিরে ছিলেন বিধায় তাঁর দাবি কেউ আমলে নেননি। তিনি ভাষণস্থলে উপস্থিত ছিলেন—এমন দাবিও করেননি।

বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার ভুল স্বীকার করায় তাঁদের ভাষ্য নিয়ে জাতিসংঘে জটিলতা হবে না। কিন্তু ড. ইমতিয়াজ তো এখনো তাঁর দাবি মিথ্যা ছিল এমন কথা বলছেন না। তাই ভাষণ বিকৃত করে তাঁর লেখা নিয়ে জাতিসংঘে এবং দেশের মানুষের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে এ জন্য যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা কেন্দ্রের প্রধান। তাঁর বিশেষ অবস্থানের কারণেই জাতিসংঘে এবং দেশের ভেতরে অনেকের মনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সে ধরনের জল ঘোলা করা পরিস্থিতি এড়ানোর একটি পথই উন্মুক্ত রয়েছে, তা হলো তাঁর বইয়ে লেখাটি ভুল ছিল বলে স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, যা এ কে খন্দকার করেছিলেন। সেদিন যাঁরা বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ানো ছিলেন, যথা জনাব তোফায়েল আহমেদ, মহিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখের সঙ্গে কথা বলে ড. ইমতিয়াজ নিশ্চিত হতে পারবেন যে তিনি যা লিখেছেন তা সত্যি নয়। তা না হলে বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে বিবিধ প্রশ্ন উঠতে পারে। ড. ইমতিয়াজের বয়স তখন সাত-আট বছরের বেশি ছিল না। সে বয়সে তিনি রেসকোর্সে হাজির ছিলেন, সামনের সারিতে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং এমন কথা শুনেছেন, যা অন্য কেউ শোনেনি, তা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। তাঁর বইয়ে তিনি লিখেছেন যে পাকিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত এক বান্ধবীর কথায় তিনি বইটি লিখেছেন। বইটিতে ড. ইমতিয়াজ প্রশ্ন তুলেছেন আসলে ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছিলেন কি না? তিনি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আরো অনেক ন্যক্কারজনক কথা লিখেছেন। এটা ভাবার যৌক্তিক কারণ রয়েছে যে সেই পাকিস্তানি বান্ধবী বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার জন্য এবং বাংলাদেশের গণহত্যায় ৩০ লাখ লোক শহীদ হননি, এই মিথ্যা দাবি প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই তাঁর বন্ধু ড. ইমতিয়াজকে দিয়ে বইটি লেখিয়েছিলেন। আজ যখন বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি নিয়ে গোটা জাতি সোচ্চার, সেখানে ড. ইমতিয়াজ কর্তৃক শহীদদের সংখ্যা নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্ন আমাদের সেই দাবিকে খাটো করতে পারে বৈকি। সেই অর্থেও ড. ইমতিয়াজের উচিত হবে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর মিথ্যাচার এবং ভ্রান্তি স্বীকার করে নেওয়া। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার এমন কর্মপন্থা নেওয়া উচিত হবে, যাতে ড. ইমতিয়াজ তাঁর মিথ্যাচার স্বীকার করতে বাধ্য হন।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

শেয়ার করুন