তুমুল যুদ্ধ চলছে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় বাখমুত শহরে। রুশ বাহিনীকে প্রতিরোধে এখনো লড়ে যাচ্ছেন ইউক্রেনের সেনারা। শহরের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। যেমন শহরের একটি ভবনের ভূগর্ভস্থ কক্ষ। একের পর এক রুশ গোলার আঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠছিল কক্ষটি। আর বাইরে রাখা একটি অ্যাম্বুলেন্স থেকে ভেসে আসছিল আহত এক ইউক্রেনীয় সেনার আর্তনাদ।
ওই সেনার কাছে ছিলেন কয়েকজন চিকিৎসক। সহায়তায় এগিয়ে যাচ্ছিলেন আরও কয়েকজন সেনা। হঠাৎ কাছেই আছড়ে পড়ল আরেকটি গোলা। বিকট শব্দের প্রতিধ্বনিতে কানে তালা লাগার জোগাড়। বাধ্য হয়ে সবাই আবার নিরাপদে আশ্রয় নিলেন। এ সময় আহত সেনাটি চিকিৎসকদের বলছিলেন, ‘আমার এত শীত করছে কেন? মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে যাচ্ছি।’
বাখমুতে ভয়াবহ এই পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখেছেন এএফপির সাংবাদিকেরা। ইউক্রেনীয় সেনাদের সঙ্গে শহরটি পরিদর্শনের সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁরা। এই সাংবাদিকদের ভাষায়, বাখমুতের আবাসিক ভবনগুলো বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আঙিনায় ছড়িয়ে আছে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ধাতব বস্তু ও কাচের টুকরা। রয়েছে বেসামরিক মানুষের কবর। বোঝা যায়, তাড়াহুড়া করেই কবরগুলো দেওয়া হয়েছে।
বাখমুতের পশ্চিমাঞ্চলে অনেক ভূগর্ভস্থ কক্ষে গাদাগাদি করে অবস্থান নিয়েছেন ইউক্রেনীয় সেনারা। সেখান থেকেই নিজ শহর রক্ষায় শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁরা। এককালে লবণ খনি ও মদ উৎপাদনের জন্য পরিচিত এ শহরটির ৮০ ভাগের বেশি এলাকা এখন রুশ বাহিনীর দখলে। তবে এই দখল নিতে তাঁদেরও কম মূল্য দিতে হয়নি।
‘আমরা ক্লান্ত’
এএফপির সঙ্গে কথা বলেছেন বাখমুতে ইউক্রেনের একটি সেনা ব্যাটালিয়নের ডেপুটি কমান্ডার। পরিচয় দিতে গিয়ে নিজের নাম বললেন ‘ফিলোসফার’ (দার্শনিক)। তিনি বলেন, ‘দিন হোক কিংবা রাত, তারা (রুশ বাহিনী) হামলা বন্ধ করে না। শুধু যখন আমরা তাদের ওপর হামলা চালাই, তখন তারা নিজেদের হতাহত সেনাদের সরিয়ে নিতে ব্যস্ত থাকে। এ সময় শুধু তাদের হামলা বন্ধ থাকে।’
ওই সেনা কর্মকর্তা কথা বলছিলেন একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষ থেকে। মাথার ওপর তখন চলছে অবিরাম গোলাবর্ষণ। রুশ সেনারা ধীরে ধীরে পুরো বাখমুত দখল করে নিচ্ছে জানিয়ে তিনি বললেন, ‘আমাদের পরিস্থিতি তুলে ধরতে গেলে এটা বলতে হবে, আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। আমাদের সেনারা অবসাদগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে।’
ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর ৯৩তম ব্রিগেডে দায়িত্ব পালন করছেন এএফপির সঙ্গে কথা বলা এই সেনা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি এখানে টিকে থাকতে পারি। তাহলে সেটা সেনাবাহিনীর অন্য ইউনিটগুলোর পাল্টা হামলা চালানোর জন্য সুযোগ বাড়াবে।’
সড়কের নাম ‘জীবনের রাস্তা’
বাখমুতে যেটুকু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেটুকু টিকিয়ে রাখা ইউক্রেনীয়দের জন্য জরুরি। কারণ, এই এলাকায় একটি মাত্র সড়ক রয়েছে, যেটি দিয়ে ইউক্রেন বাহিনীর কাছে প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করা হচ্ছে। তারা এই সড়কটির নাম দিয়েছে ‘জীবনের রাস্তা’।
জীবনের রাস্তা সড়কটির দৈর্ঘ্য ২৫ কিলোমিটার। সবচেয়ে কাছের ইউক্রেননিয়ন্ত্রিত সরবরাহকেন্দ্রের সঙ্গে বাখমুতকে যুক্ত করেছে সেটি। বাখমুতের আহত সেনাদের সরিয়ে নিতে বা নতুন সেনাদের শহরটিতে আনতে এই সড়কটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে সড়কটির পাশে পড়ে থাকা বিধ্বস্ত যানবাহনগুলো দেখলে বোঝা যায় এই এলাকায় কতটা ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে ইউক্রেনের একজন ড্রোন পরিচালক বলেন, ‘ওপর থেকে, আকাশ থেকে, আপনি শুধু গর্ত দেখতে পাবেন। লন্ডভন্ড এক অবস্থা।’
এ নিয়ে ইউক্রেনের সেনাসদস্য আন্দ্রি বলেন, ‘আপনি যদি এই রাস্তাটি ধ্বংস করে দেন, তাহলে বাখমুতের সবাই মারা যাবে। কোনো কিছু সরবরাহ করা যাবে না। কোনো গোলাবারুদ, খাবার—কিছুই থাকবে না। শহরটি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।’
শঙ্কার কথা হলো এই সড়কের অনেক কাছাকাছি এসে পড়েছেন রুশ সেনারা। ইউক্রেনের সেনাসদস্য আলেক্সান্দার বলছিলেন এ কথা। সড়কে একটি গাড়িতে বসে আঙুলের ইশারায় তিনি দেখালেন, মাত্র ৯০০ মিটার দূরেই রুশ বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। ফলে যেকোনো সময় সড়কটি তাদের দখলে চলে যেতে পারে।
জয়ের দাম যখন চড়া
ইউক্রেনের সেনাসদস্য আন্দ্রি বলেন, ‘হাতে যা কিছু আছে তার সব আমাদের দিকে ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। রকেট, মর্টার ও ট্যাংকের মাধ্যমে তারা সবকিছু আমাদের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে। লুকানোর কোনো জায়গা নেই।’
বাখমুতে রুশ বাহিনীকে টেক্কা দিতে অত্যাধুনিক গোলাবারুদ লাগবে বলে জানালেন অনেক ইউক্রেনীয় সেনা। এমন গোলাবারুদের যে ঘাটতি রয়েছে, তা বোঝা গেল আন্দ্রির কথাতেই। তিনি হতাশা ঝেড়ে বললেন, ‘আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে। পর্যাপ্ত অস্ত্র নেই। এভাবে হয় না।’
বাখমুত দখলে রাখার কৌশলগত গুরুত্ব খুবই কম বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। তবে এর বড় রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো, বাখমুতের লড়াইয়ে যে পক্ষ শক্তিমত্তার দিক দিয়ে এগিয়ে থাকবে, তারাই এ যুদ্ধে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
কিয়েভের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের গবেষক মাইকোলিয়া বাইলিসকভ বলেন, ‘রাশিয়া যদি পুরো বাখমুত দখলে নেয়, এটা হবে চড়া মূল্যে যুদ্ধ জয়ের মতো। এটা নিশ্চিত যে তাদের আক্রমণ শেষ হবে চরম ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে।’