বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর আসনের সংসদ সদস্য যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি বলেছেন, জননেত্রী শেখ হাসিনা খুবই সাহসী মানুষ। কতটা সাহসী সেটি আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করার পর ১৭ মে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন। সেদিন তিনি এসে বঙ্গবন্ধুর পথে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পথটি একধাপ এগিয়ে দিয়েছিলেন।
১৭ মে (বুধবার) শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মোকতাদির চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ দেশে ভুলন্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে দেশটাকে টেনে তোলা অনেকটা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা নিজেদের ভিতরে কোনো আত্মসমালোচনা না করে, নিজেদের সংশোধন না করে, পঁচাত্তরের ১৫ ই আগস্টের চক্রান্ত থেকে শিক্ষাগ্রহণ না করে পরস্পরের বিরুদ্ধে আমরা চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিলাম। আমরা কেউ মালেক উকিল গ্রুপ, কেউ রাজ্জাক গ্রুপ, কেউ তোফায়েল গ্রুপ, কেউ কামাল হোসেন গ্রুপ, এভাবে আমরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলাম।
সাবেক ছাত্রনেতা মোকতাদির চৌধুরী বলেন, শুধু আওয়ামী লীগ নয়; আওয়ামী লীগের চালিকা শক্তি যে ছাত্রলীগ,স৷ সেখানেও অনেক বিভেদ ছিল। সেসময় দিল্লিতে গিয়েছিলাম নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য, সেখানে আমি তাঁর সাথে ওয়াদা করেছিলাম যে, আমি কোনো গ্রুপিংয়ের সাথে থাকব না। আমি আমার কথা রেখেছি।
তিনি বলেন, নেত্রী দেশে ফিরে আসার পরে ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়েছিল। সেই সম্মেলনে ৩২ নম্বরে (ধানমন্ডি-৩২) আমরা কমিটি গঠনের জন্য বসে ছিলাম। সেখানে আমাদের বন্ধু ফজলুর রহমান ও বাহালুল মজনু চুন্নু- এই দুইজনকে আমি বলেছিলাম যে, আমরা এখান থেকে যাব না। তারা প্রস্তাব দিয়েছিল আসুন আমরা এখান থেকে সরে গিয়ে অন্য কোথাও বসি বা আগামীকাল বসে প্যানেল করি। তখন আমি বলেছিলাম- এটা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, নেত্রী চান এখানে বসে প্যানেল হোক, সুতরাং এখানের বাহিরে আমি যাবো না, প্যানেল এখানেই করবো।
জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোকতাদির চৌধুরী বলেন, এটা ঠিক যে, এই প্যানেল গঠন করার পরে সাময়িকভাবে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে অনেক দ্বিধা-বিভক্তি এসেছিল, কিন্তু স্থায়ী ঐক্য গড়ে উঠার পেছনে তা এক বিশাল পদক্ষেপ ছিল। সেসময় ফজলুল-চুন্নু ‘রক্তের উত্তরাধিকার নয়, আদর্শের উত্তরাধিকার’-এ কথা বলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সিপাহসালার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে তারা বাকশাল গঠন করে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, এই বাকশালের সংগঠন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও হয়েছিল। অনেক আশা করেছিলেন, আমি হয়তো বাকশালিদের সাথে থাকব; কিন্তু আমি শেখ হাসিনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করব-এমনটা কখনো ভাবিনি, তাই আমি যায়নি বাকশালিদের সাথে। আমি তখন জালাল-জাহাঙ্গীর গ্রুপের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম।
প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, আমরা যে সেদিন সঠিক ছিলাম, তা ইতিহাস প্রমাণ করে। আর সেদিন যারা বামপন্থী রাজ্জাককে আওয়ামী লীগ থেকে বের করে দিয়ে উল্লসিত হয়েছিল, কিছুদিন পর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভেদ তৈরি হলে দলের ডানপন্থীরাও কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বের হয়ে গিয়েছিল।
মোকতাদির চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনা শুধু দেশে আসেন নাই, কত কী ষড়যন্ত্র তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। তাঁকে যারা বাহির থেকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল- ফ্রিডম পার্টি, ডেমোক্র্যাট পার্টি, মুস্তাকের অনুচরেরা সেগুলো শুধু দেখেছেন। কিন্তু ভেতর থেকে তিনি কী পেয়েছেন? আমাদের অনৈক্য তাঁকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক এই একান্ত সচিব বলেন, আমি তখন সরকারি চাকরিতে চলে গিয়েছিলাম। নেত্রী আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি আর কাদের (ওবায়দুল কাদের) রাজ্জাক সাহেবকে গিয়ে বুঝাও তিনি যেন আমার ডাকা মিটিংয়ে আসেন।’ আমরা উভয়ই নেত্রীর অনুরোধে রাজ্জাক সাহেবের বাসায় গিয়েছিলাম। আমি তাঁকে অনুরোধ করে বলেছিলাম, রাজ্জাক ভাই- আপনি পার্টিটাকে ভাঙিয়েন না। শেখ হাসিনা দলের সভানেত্রী। সভানেত্রীর সভা ডাকার অধিকার আছে, তিনি আপনাকে সেই সভায় আসার অনুরোধ করেছেন। রাজ্জাক ভাই বললেন, আমি যদি সেখানে যায় তাহলে আমাকে এক্সপেল করা হবে। আমি বললাম, আপনাকে এক্সপেল করা হবে না, আপনি সভাতে উপস্থিত থাকেন। শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করেন। মাত্র কয়েকমাস হলো তিনি দেশে এসেছেন, এই কয়েকমাসে পার্টির ভিতরে অনৈক্য তৈরি করা ইতিহাস ভালোভাবে নেবে না। ওনি গ্যারান্টি চাইলেন। আমি বললাম, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি আপনাকে। তখন বললেন, তুমি কে? আমি বললাম, আমি হলাম রবিউল আলম চৌধুরী, আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিতে পারি- তা আপনি জানেন। আমার বন্ধু ওবায়দুল কাদের সাহেবও বললেন, আমরা গ্যারান্টি দিচ্ছি- আপনাকে এক্সপেল করা হবে না। আপনি সভা পরিচালনা করবেন। রাজ্জাক ভাই সেই সভায় যাননি। সেই ভুলের খেসারত তাকে দিতে হয়েছিল।
মোকতাদির চৌধুরী আরও বলেন, শেখ হাসিনা যখনই দলের হাল ধরেছেন, তখন থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে এবং তাকে কোনঠাসা করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকেই মনে করেছিলেন, শেখ হাসিনা তো আমাদের তুলনায় একেবারেই শিশু। সুতরাং আমরা যখন যা বলব- তাইতো শুনবেন। রাজ্জাক সাহেব মনে করতেন তিনি ভারতের অনেক বিশ্বস্ত, শেখ হাসিনা যেহেতু দীর্ঘদিন ভারতে থেকেছেন,সেহেতু তিনি যা বলবেন শেখ হাসিনা তা-ই শুনবেন। কামাল হোসেন মনে করতেন তিনি যা বলবেন শেখ হাসিনা তা-ই শুনবেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ছিলেন মধ্যপন্থী। তিনি ডানেও যাননি, বামেও যাননি। তিনি চলেছেন সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের যারা এখানে উপস্থিত হয়েছেন- তাদেরকে বলব, শেখ হাসিনার পথ-ই আমাদের পথ। আমরা বুঝি জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। আমরা বুঝি, জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি। আমরা বুঝি লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা। এর বাহিরে আমাদের কোনো বুঝ নাই।
মোকতাদির চৌধুরী বলেন, অনেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম শুনলে মনে করেন না জানি কী বড় শক্তি! কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলা করেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। তাদের সপ্তম নৌবহরের হুমকিকে উপেক্ষা করে ই বাংলার স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল।
তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে আমাদের অবস্থান হতে হবে ডু অর ডাই। অনেক সুহৃদরা আমাদের নানারকমের পরামর্শ দিবে। কারো পরামর্শ আমাদের দরকার নেই।
তিনি আরও বলেন, যারা বলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া হলো সংকীর্ণতাবাদীদের আখড়া, আমি তাদের উত্তর দেওয়ার জন্যই মিসেস নায়ার কবির যে এখানকার মেয়র সেই কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দেই। তিনি একজন আধুনিক প্রগতিশীল মানুষ। যে শহরের মানুষজন তাঁকে ভোট দিয়ে মেয়র নির্বাচিত করতে পারে, স শহরের মানুষজন কখনোই সংকীর্ণতাবাদীদের সাথে যায় না। আগামী সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৬টি আসনেই নৌকা প্রতীকের প্রার্থী দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে তিনি দাবি জানান।