২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে জাতীয় সংসদে। এই বাজেট বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট। এর মধ্যে সরকারের পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে চার লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
এখানে উন্নয়ন বাজেটটা অনেক কম। কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, রেভিনিউ বাজেটের তুলনায় উন্নয়ন বাজেটের শতকরা হিসাবে আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে। এটা কিন্তু খারাপ লক্ষণ। সরকার পরিচালনা করতে যে বাজেট করা হয়, যেটাকে বলে রেভিনিউ বাজেট বা অনুন্নয়ন বাজেট, সেটা কিন্তু আকারে বাড়ছে।
এর অর্থ হচ্ছে বড় আকারের সরকার এবং অনেক বেশি ব্যয় করছে। এর মধ্যে সুদ ব্যয় আছে, বেতন-ভাতা, এরপর নতুন নতুন স্কুল, কলেজ আত্তীকরণ ইত্যাদি আছে। রেভিনিউ বাজেটে উদ্বৃত্ত যেটা থাকে, সেটা উন্নয়ন বাজেটে যায়। আমরা আগে যেটা বলতাম রাজস্ব বাজেট, সেটা বাদ দিয়ে বাজেটে প্রথমটা ‘পরিচালনাগত’ লেখা হয়েছে।
কারণ সেটা তো ব্যয় করতেই হচ্ছে। তার পরেরটা হচ্ছে উন্নয়ন বাজেট। উন্নয়ন বাজেটের বিরাট একটা অঙ্ক ঘাটতি অর্থায়ন থেকে হবে। ব্যাংক থেকে হবে। বাকিটা বিদেশি ঋণ এবং অনুদান থেকে হবে।
এখানে একটা কথা হচ্ছে, একে তো গেল বড় আকারের বাজেট। সেখানে শতাংশের হিসাবে রাজস্ব বাজেটের তুলনায় উন্নয়ন বাজেট ছোট হচ্ছে। আরেকটা হচ্ছে, উন্নয়ন বাজেটের ঘাটতি মেটানোর জন্য এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে সরকার। বাকিটা সঞ্চয়পত্র ইত্যাদির মাধ্যমে নেবে। ঘাটতি হচ্ছে প্রায় দুই লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সেটা জিডিপির ৫.২ শতাংশ।
বাজেটের এই ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, যেটা প্রিন্টিং দ্য মানি অর্থাৎ টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিচ্ছে। এটার খুব খারাপ দিক হচ্ছে, এটা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। আর ব্যাংক থেকে যে অংশটা নেওয়া হয়, এর ফলে প্রাইভেট সেক্টরের লোন কমে যায়। অর্থাৎ ব্যবসা চালানোর জন্য যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, সেটা কম হয়। তাতে হয় কী, বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয় এবং আমাদের কাঙ্ক্ষিত যে বিনিয়োগ সেটা হয়ে ওঠে না। সরকার জিডিপির ৩৩ শতাংশের মতো বিনিয়োগ হবে বলেছে। কিন্তু এগুলো নির্ভর করছে কর আদায়ের ওপর। ১৬ শতাংশের বেশি অতিরিক্ত কর আদায় করতে হবে। এটা কোথা থেকে আসবে! কর তো মানুষ আগে থেকেই দিচ্ছে। অর্থনীতি ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে না, এটা আমার অ্যাসেসমেন্ট। এখানে যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, জিডিপি গ্রো করবে ৭.৫ শতাংশ, এটা অসম্ভব। এখন সেটা যদি না করে, তাহলে ভ্যাট আদায়, অন্য ট্যাক্স আদায় কমবে। অতিরিক্ত কর আদায় অত সহজ হবে না।
আর মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ রাখাও সম্ভব হবে না। কারণ মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে তিনটা বিষয়ের ওপর। একটা হলো ঘাটতি বাজেট—সরকার এটা বড় করতে থাকবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ করতে থাকবে। এটা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে বাধ্য। আরেকটা হলো ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য। ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটে ডলারের বিপরীতে আমাদের টাকা মূল্য হারাচ্ছে। আগে ছিল ৮৫ টাকা, এরপর ৯০ টাকা, এরপর ৯৫ টাকা, এরপর ১০০ টাকা, এরপর ১০২ টাকা, আর এখন ১০৮ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক এটা যদি স্থিতিশীল করতে না পারে, তাহলে আমরা ইমপোর্ট করে বাইরে থেকে যা আনছি, সেটা বেশি দামে আনতে হবে। সুতরাং মূল্যস্ফীতি হবেই এখানে। ওটা নির্ভর করছে এক্সচেঞ্জ রেট কতটা স্থিতিশীল থাকছে তার ওপর।
মূল্যস্ফীতি আরেকটা যে বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, সেটা হচ্ছে জ্বালানি তেলের দামের ওপর। ফুয়েল বা জ্বালানি তেল তো সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। এক বছর আগে সরকার ফুয়েলের দাম ৫০ শতাংশের মতো বাড়িয়ে দিল। তখন তো মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগল। কারণ ট্রান্সপোর্ট খরচ, কৃষির উৎপাদন খরচ—সব কিছু জড়িত এই ফুয়েল প্রাইসিংয়ের ওপর। একটা ভালো জিনিস দেখলাম যে আমদানি পর্যায়ে পেট্রোলিয়ামজাত ১৩টি পণ্যের ওপর থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ অগ্রিম কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। ওটা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমতে পারে।
এই যে তিনটা বিষয়। একটা হচ্ছে ঘাটতি বাজেট, যদি সরকার সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়বে বেশি। আর বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে যদি ঋণ করে, তাহলে প্রাইভেট সেক্টরে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। সুতরাং দুই দিকেই বিপদ আছে। এ ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে ঘাটতি কম করা। কিন্তু সরকার সেটা পারবে না। কারণ সরকার তো বিরাট আকারে বাজেট দিয়ে বসে আছে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, টাকার বিপরীতে ডলারের হার যদি স্থিতিশীল না রাখতে পারে, মূল্যস্ফীতি রোধ করা যাবেই না।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে, করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স স্ট্রাকচারের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। ওটা এক দিক দিয়ে ঠিক আছে। এই বছর হয়তো খুব খারাপ সময় যাচ্ছে, ওখানে আমরা বলেছিলাম ট্যাক্স রেট কমানোর জন্য। সেটা কমানো সম্ভব হয়নি বা কমায়নি। অন্তত বাড়ায়নি, এটা ভালো খবর।
আরেকটা বিষয় লক্ষ করলাম, বিদেশি ঋণ এবং বিদেশি ঋণের সুদ দেওয়ার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। দুই-তিন বছর আগে থেকে যেটা দিতাম সেটা এ বছর দ্বিগুণ হয়ে গেছে, যেটা সামনের বছর দিতে হবে। এগুলো ফরেন এক্সচেঞ্জেই দিতে হবে অর্থাৎ মার্কিন ডলারে দিতে হবে। এভাবে ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। ৩০ বিলিয়ন ডলার অথবা ৩২ বিলিয়ন ডলার যা-ই হোক না কেন, আমরা যদি ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ধরে রাখতে না পারি, যদি এটা নিচের দিকে নামতে থাকে, তাহলে কিন্তু আমাদের সমস্যা আরো ঘনীভূত হবে। আরেকটা হচ্ছে, বলা হয়েছে যে এক্সচেঞ্জে রেটটা যেন এক থাকে। কিন্তু এটা এ দেশে কখনোই সম্ভব না। এখানে ইনফরমাল মার্কেটে এক রকম থাকবে—এটা অতীতেও দেখা গেছে। গত ৩০ থেকে ৪০ বছর তো আমরা তা-ই দেখছি—বাইরে কিনতে গেলে মূল্য হয়ে যাবে আরেক। ওটা এক করা সম্ভব নয়। সরকার ডলারের সঙ্গে টাকার এক্সচেঞ্জ রেট যদি ১০৮ টাকা বা ১০৭ টাকা করে, তাহলে এটা বাইরে ১১০ টাকা বা ১১২ টাকায় কিনতেই হবে ইনফরমাল মার্কেট থেকে, যেটাকে আমরা বলে থাকি কার্ব মার্কেট। ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে আমরা দেখছি, এক্সচেঞ্জ রেট দুই মার্কেটে ভিন্ন থাকে। এখানে এক করা সম্ভব নয়। আমিও মনে করি, এটা করা যাবে না। এটার চিন্তা না করাই ভালো।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে, অতিরিক্ত কর আদায়। অর্থনীতির অবস্থা যদি খুব ভালো যায়, তাহলে হয়তো পারবে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় না অর্থনীতির অবস্থা তেমন ভালো যাবে। ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও হবে না, বাড়তি কর আদায়ও সম্ভব হবে না।
তবে যা হোক, খুব খারাপ সময়ে ভালো বাজেট দিয়েছে, এটা বলা যায়। অর্থনীতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু বাজেট যা দেখলাম, তাতে মনে হচ্ছে বেশি আশা করছে। বিভিন্ন সূচক কিন্তু তা-ই বলছে। মূল্যস্ফীতি, এক্সচেঞ্জ রেট, কর্মসংস্থান কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতি—সব কিছু মিলিয়ে অর্থনীতি কিন্তু খারাপের দিকেই যাচ্ছে। চার লাখের মতো লোক কিন্তু দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। যেটা আগে ছিল ২০ শতাংশ, সেটা এখন ৩৫ শতাংশ হয়ে গেছে। এদের তো কম মূল্যে খাওয়াতেই হবে। সরকার এটা কত দিন পারবে! এটা নিয়ে খুব চিন্তিত মানুষ। নিম্ন আয়ের মানুষকে সাহায্য করার একমাত্র উপায় হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাখা। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য আমি বাজেটে ভালো কিছু দেখছি না।
যদি ডলার এক্সচেঞ্জ রেট, জ্বালানির দাম কমিয়ে রাখতে পারে, সেটা একটা উপায় হতে পারে। ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নটা যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কম টাকা গ্রহণ করে, ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে করে, তাহলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কম থাকতেও পারে।
তার পরও সব কিছু মিলিয়ে আশাবাদী হতে হবে। অর্থনীতি ভালো হবে। আর সে আশাবাদ নির্ভর করছে একটা ভালো নির্বাচনের ওপর। যদি একটা ভালো নির্বাচন হয়, তাহলে আশাবাদ জাগ্রত হবে। সবাই আবার একটু কনফিডেন্ট ফিল করবে। আর যদি একটা ভালো নির্বাচনের দিকে না যায়, তাহলে দেশে হতাশা বাড়বে এবং অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন : রায়হান রাশেদ