ন্যূনতম আয়কর দুই হাজার টাকা প্রত্যাহার করা প্রয়োজন

নিরঞ্জন রায়

বাজেট ঘোষণার পর থেকে যেসব নেতিবাচক আলোচনা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ন্যূনতম দুই হাজার টাকা আয়কর প্রদান বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত। কোনো ব্যক্তি যদি আয়কর রিটার্ন জমা দেন, তাহলে তাঁকে দুই হাজার টাকা আয়কর হিসেবে প্রদান করতে হবে, তাতে তাঁর বার্ষিক উপার্জনের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, এমনকি করযোগ্য আয়ের নিচে হলেও। এই সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে যতটা লাভ হবে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। অনেকেই ভাবতে পারেন যে দুই হাজার টাকা তেমন কিছু নয়।

পরিমাণের দিক থেকে এই অর্থ হয়তো তেমন কিছু নয়, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে এই অর্থ প্রদান সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ংকর অসন্তোষের সৃষ্টি করবে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ প্রয়োজন নেই এমন খাতে এক টাকাও ব্যয় করতে চায় না, যদিও অনেকেই কারণে-অকারণে অনেক অর্থ ব্যয় করে থাকে।

এ রকম একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্দেশ্য আমাদের কাছে মোটেও পরিষ্কার নয়। সরকার যদি রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে সেটি খুব একটা সফল হবে বলে মনে হয় না।

গত কর বছরে মোট আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা ৩০ লাখের নিচে। যদি ধরে নেওয়া যায় যে বাধ্যতামূলক আয়কর রিটার্ন দাখিলের শর্তের কারণে চলতি বছরে আয়কর রিটার্নের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ লাখ হবে, যার মধ্যে ৩০ লাখ রিটার্ন জমাদানকারীর বার্ষিক আয় করযোগ্য আয়সীমার নিচে। সুতরাং এই ৩০ লাখ করদাতা তখন প্রত্যেকে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা আয়কর প্রদান করবে এবং এর ফলে মোট অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হবে ৬০০ কোটি টাকা। এই রাজস্ব মোট বাজেটারি বরাদ্দ সাত লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার ০.০৮ শতাংশ, মোট পাঁচ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের ০.১২ শতাংশ, মোট ঘাটতি দুই লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার ০.২৩ শতাংশ এবং দেশের ব্যাংক খাত থেকে গৃহীত ঋণ এক লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকার ০.৪৫ শতাংশ।

অর্থাৎ প্রস্তাবিত বাজেটের রাজস্বসংক্রান্ত যতগুলো প্রাক্কলন ধরা হয়েছে তার যেকোনোটির তুলনায় এই ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব হবে ০.৫০ শতাংশেরও নিচে, তাও যদি এই অতিরিক্ত ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় সম্ভব হয়।

ন্যূনতম আয়কর দুই হাজার টাকা প্রদানের শর্ত বাধ্যতামূলক করায় সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেতে পারে নামমাত্র, কিন্তু এই সিদ্ধান্তের কারণে জনগণের মাঝে সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাবে মারাত্মকভাবে। অথচ সরকার চাইলেই এই সিদ্ধান্ত না-ও নিতে পারে। সরকার যদি দুই লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে পারে বা দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে যদি এক লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে সেই সঙ্গে এই ৬০০ কোটি টাকার জোগাড়ও খুব অনায়াসেই করতে পারবে। এ জন্য যে সিদ্ধান্ত মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করতে পারে, তা এই মুহূর্তে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

আরো একটি বিষয় এখানে প্রণিধানযোগ্য, তা হচ্ছে যদি এ রকম বাধ্যতামূলক ন্যূনতম আয়কর ধার্য করতেই হয়, তাহলে যাদের উপার্জন থেকে উৎস কর কর্তন করা হয়েছে, তা সমন্বয় করার সুযোগ রাখা প্রয়োজন। যেমন—কোনো ব্যক্তির যদি ব্যাংকে ১০ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত থাকে এবং সেখান থেকে যদি তিনি বছরে এক লাখ টাকা সুদ পেয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে ব্যাংক সেই সুদ থেকে ১০ হাজার টাকা উৎস কর কেটে সরকারকে প্রদান করবে। এ ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির রিটার্ন জমাদানের সময় ন্যূনতম দুই হাজার টাকা প্রদানের বিষয়টি প্রযোজ্য হবে না।

অর্থ মন্ত্রণালয় বা এনবিআর (ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ) দেশের আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে যদি এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে তাদের সেই উদ্যোগ সফল হওয়ার সম্ভাবনা যে খুবই কম, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা অন্তত তা-ই বলে। গত বছরের বাজেটেও নতুন এক বিধান জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, যার মাধ্যমে অত্যাবশ্যিক কিছু সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমাদানের প্রমাণ সরবরাহের শর্ত বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। তার পরও গত বছরের আয়কর রিটার্ন জমাদানের সংখ্যা ৩০ লাখ অতিক্রম করতে পারেনি। আয়কর রিটার্ন জমাদানের ব্যাপারে এনবিআরের হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতির অন্ত নেই। কিন্তু তার পরও দেশে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এই সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে অবশ্যই সেটি ভয়ভীতি দেখিয়ে বা কোনো রকম শর্ত জুড়ে দিয়ে জনগণকে চাপে ফেলে সম্ভব নয়। ভয় দেখিয়ে বা শর্ত জুড়ে দিয়ে জনগণকে বাধ্য করে আয়কর রিটার্নের সংখ্যা বৃদ্ধি করার কৌশল ব্যর্থ হয়েছে অনেক আগেই। এখন আয়কর রিটার্ন জমাদান সহজ করে এবং সেই সঙ্গে নানা রকম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎসাহ দিয়ে জনগণকে আয়কর রিটার্ন দাখিলে অনুপ্রাণিত করা হয়। এই কৌশল অবলম্বনের কারণে যে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, তা আজ অনেক দেশেই প্রমাণিত সত্য।

সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও দেশের মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালীর দিকে তাকিয়েও অনুমান করা যায় যে দেশে বর্তমানে প্রায় তিন কোটির মতো মানুষ আয়কর প্রদানের আওতায় পড়বে এবং প্রায় ১২ কোটি মানুষ আয়কর রিটার্ন দাখিলের আওতায় আসবে। এ কথা অনস্বীকার্য যে এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দেশের আয়কর রিটার্নের আওতায় আনতেই হবে এবং এর কোনো বিকল্প নেই। শুধু তা-ই নয়, এই কাজটি যত দ্রুত সম্পন্ন করা যায় ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল। তবে অবশ্যই সেটি করতে হবে আধুনিক কর পদ্ধতি অনুসরণ করে। অর্থাৎ কোনো রকম ভয়ভীতি বা জোরজবরদস্তির আশ্রয় না নিয়ে মানুষকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে আয়কর রিটার্ন দাখিলের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এনবিআর যদি কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে, তাহলে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে দেশের ১২-১৩ কোটি মানুষকে আয়কর রিটার্ন দাখিলের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। এসব পদক্ষেপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—১. আয়কর রিটার্ন দাখিল পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর বা ডিজিটাল করতে হবে, যেখানে রিটার্ন জমা দেওয়া থেকে শুরু করে অ্যাসেসমেন্ট নোটিশ ইস্যু হওয়া পর্যন্ত সব কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হবে। ২. প্রথমবারের মতো যারা রিটার্ন দাখিল করবে, বিশেষ করে যাদের আয় ও সম্পদের পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের নিচে থাকবে, তাদের প্রদত্ত তথ্য নিয়ে কোনো রকম প্রশ্ন উত্থাপন করা হবে না। এবং ৩. রিটার্ন দাখিলে কোনো রকম ভুলত্রুটি থাকলে সে জন্য রিটার্নদাতাকে অভিযুক্ত না করে শুধরে দিতে হবে কমপক্ষে পর পর তিন বছর। মোটকথা, জনগণের মধ্যে যে আয়কর কর্মকর্তা বা আয়কর অফিস সম্পর্কে এক ধরনের ভীতি আছে, তা সবার আগে দূর করে আয়কর কর্মকর্তা ও অফিসকে সাহায্যকারীর ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ রকম আরো কিছু পদক্ষেপ নিতে পারলে আমি নিশ্চিত দেশের মানুষ নিজেদের উদ্যোগেই রিটার্ন জমা দিতে এগিয়ে আসবে।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বর্তমান বাজেটে প্রস্তাবিত ন্যূনতম দুই হাজার টাকা আয়কর প্রদান বাধ্যতামূলক করার ফলে সরকারের তেমন কোনো লাভ হবে না, অথচ দুর্নামের ভাগী হতে হবে। এই সিদ্ধান্তের কারণে বৃহত্সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে রিটার্ন জমাদানের আওতায় আনার সুযোগ বিঘ্নিত হবে। নির্বাচনের বছর জনগণ সরকারের অনেক ভালো কাজের কথা ভুলে এই কারণে সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট হবে এবং বিরোধীপক্ষ অকারণে সরকারের সমালোচনা করার সুযোগ পাবে। আমি নিশ্চিত প্রধানমন্ত্রীর নজরে বিষয়টি আসেনি, আসলে তিনি এমন সিদ্ধান্ত আপাতত নিতে দিতেন না। যেভাবেই হোক বিষয়টি বাজেটে প্রস্তাব আকারে এসেছে। যেহেতু বাজেট এখনো পাস হয়নি, তাই ন্যূনতম দুই হাজার টাকা আয়কর প্রদানের সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করে বৃহত্তর স্বার্থে প্রত্যাহার করে নেওয়া প্রয়োজন।

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা

Nironjankumar_roy@yahoo.com

শেয়ার করুন