ব্যাংকের পরিচালক পদের মেয়াদ ৯ বছর থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করে বিল পাসের প্রতিবাদে জাতীয় সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছেন প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির (জাপা) সংসদ সদস্যরা।
আজ বুধবার সংসদে ওই সংশোধনী এনে ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধনী) বিল ২০২৩’ পাসের প্রতিবাদ করে ওয়াকআউট করেন তারা।
এর আগে সংসদে জাতীয় পার্টির সদস্যরা হইচই, চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকেন। এতে সাময়িক সময়ের জন্য সংসদে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
ওয়াকআউটের আগে জাতীয় পার্টির এমপিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ব্যাংক লুটপাটের মূল হোতা পরিচালকরা। তাদের সুবিধা দেওয়ার জন্য আইন সংশোধন করা হচ্ছে। বিল সংসদে উত্থাপন ও সংসদীয় কমিটির সুপারিশে ছিল না- এমন বিধান যুক্ত হয়েছে। তার চেয়ে পরিচালকদের মেয়াদ আজীবন করে দেওয়া হোক।
অবশ্য স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে সংসদে রুলিং দেন। পরে জাতীয় পার্টির অনুপস্থিতিতে বিলটি পাস হয়।
গত ৮ জুন ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল ২০২৩’ জাতীয় সংসদে তুলেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সংশোধনীর মূল প্রস্তাবে পরিচালক পদের মেয়াদ বাড়ানো–কমানোর বিষয়ে কোনো প্রস্তাব ছিল না। পরে সেটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। কমিটিও পরিচালক পদের মেয়াদ নিয়ে কোনো সংশোধনী আনেনি।
কিন্তু সংসদে এ বিলটি পাসের আগে এ বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব দেন সরকারি দলের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম। তিনি পরিচালক পদের মেয়াদ টানা ১২ বছর করার প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবটি দেখে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান জাতীয় পার্টির একাধিক সংসদ সদস্যরা। বিল পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলেন এভাবে বিলে সংশোধনী আনা যায় কি না? এ বিষয়ে তারা স্পিকারের ব্যাখ্যাও দাবি করেন।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, পরিচালক পদের মেয়াদ ১২ বছর করার জন্য সরকারি দলের একজন সদস্য সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা বিল উত্থাপনের সময় ছিল না। যেহেতু সরকারি দলের সংসদ সদস্য এ প্রস্তাব দিয়েছেন, তাই মনে হচ্ছে এটা গ্রহণ করা হবে।
তিনি প্রশ্ন রাখেন যে, বিষয়টি সংসদে উত্থাপনই হয়নি, সেটা চাওয়া হয় কী করে? ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্ত করতে হবে।
জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য মুজিবুল হক বলেন, পরিচালকরা হচ্ছেন ব্যাংক লুটপাটের মূলহোতা। কোনো পরিচালক সুপারিশ না করলে আমার মতো লোক গেলে ব্যাংক ঋণও মিলবে না। চেয়ারম্যান-পরিচালকের কারণে ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক শেষ। যে আইনের কোনো ধারা অর্থমন্ত্রী সংশোধনীতে আনেননি। যে সেকশন সংশোধনের জন্য সংশোধনী কমিটি কোনো সুপারিশ করেনি, সেখানে একজন সরকারি দলের সদস্য কোন আইনে এ সংশোধনী আনলেন। তিনি এটা পারেন কি না? এটা জানা খুবই দরকার। অভিভাবক হিসেবে স্পিকার এটা বলবেন বলে আশা করি।
চুন্নু বলেন, ‘মনে হচ্ছে, অর্থমন্ত্রীকে কনভিন্স করে সরকারি দল করেন- এমন অনেক ব্যাংকের পরিচালকদের সুপারিশে এটা আনা হয়েছে পাস করার জন্য। সেটা হলে আমরা আমাদের সব সংশোধনী প্রত্যাহার করলাম। কারণ এর চেয়ে বড় অন্যায় আর হতে পারে না। যেখানে ব্যাংক লুটপাট করা হচ্ছে। বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক বসে বসে তামাক খায়। ব্যাংকের চেয়ারম্যান-পরিচালক হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে চলে যায়। আপনারা দেখছেন না? আপনারা আছেন কাউকে ফেবার করার জন্য। পরিচালকের মেয়াদ ১২ বছর করার এ প্রস্তাবকে আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাই।’
প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে ব্যাংক মালিকদের অনুদান দেওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, তারা এ টাকা দিয়ে প্রথম ও শেষ পাতায় বড় বড় ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন- প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিচ্ছেন। আরও এক বস্তা খালেদা জিয়ার হাতে দিয়েছেন। সেটা তো প্রকাশ করেন না। এদের চরিত্র একই। এরা আপনার হাতের কলকি খেয়ে চলে যাচ্ছে। আপনাদের হাতে গন্ধটা থেকে যাচ্ছে। এখনো সাবধান হোন। এদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসেন।
কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ব্যাংক মালিকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য আইনটি আনা হয়েছে। তারা জনগণের টাকার অপব্যবহার করে। সর্দি-কাশি হলেই তারা ব্যাংকের টাকায় সিঙ্গাপুর চলে যান।
স্বতন্ত্র পরিচালক কারা এ প্রশ্ন রেখে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আমরা তার লিস্ট চাই। আমরা এ ভাগ্যবানদের সংসদে দেখতে চাই। সব দলীয়কর্মী ও আত্মীয়-স্বজনকে স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়। তারা ব্যাংকে যায়, শুধু লোন দেওয়ার জন্য। ১০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দুই কোটি নিজে নিয়ে নিলো। একদিনে ধনী হয়ে গেলো। যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। এখানে হরিলুট চলছে। আমরা কমানোর প্রস্তাব করছি না। এদের মেয়াদ আজীবন করে দেন। আমি এখন প্রস্তাব আনলাম। এ পরিচালকরা আজীবন থাকবে। আল্লাহ যতদিন হায়াত রাখছেন, আপনারা খাইতে থাকেন। আমরা দেখতে থাকি।’
কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, এ আইনে সংশোধন আনা হচ্ছে, শুধুমাত্র ব্যাংক মালিকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য। বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর খবরদারি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কে হবেন, ডেপুটি গভর্নর কে হবেন— এগুলো তারা নির্ধারণ করে দেয়। ব্যাংকারদের কাছে সরকার জিম্মি হয়ে গেছে।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, সরকার তাদের প্রিয় পরিচালকদের কীভাবে পদে রাখবেন, সেটা ভুলে গিয়েছিলেন। এ কারণে পরবর্তীতে এ সংশোধনী আনা হয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় আইনে সংশোধনী আনা হচ্ছে, তা সঠিক প্রক্রিয়ায়।
বিরোধীদলের সংসদ সদস্যদের সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, খেলাপি ঋণ ১৪ বছরে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৬ শতাংশে নেমেছে। সরকারি ব্যাংকের শাখা দ্বিগুণ বেড়েছে। ব্যাংকের আমানত ৭ গুণ বেড়েছে। বছর ওয়ারি মুনাফা বেড়েছে ৮ গুণ। তিনি আশা করেন, তার এ বক্তব্যে ভুল বোঝাবুঝির কিছুটা অবসান হবে।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম তার সংশোধনী প্রস্তাব তুলতে গেলে বিরোধীদলের সংসদ সদস্যরা হইচই করেন। তখন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, আগে সংসদ সদস্যকে সংশোধনী প্রস্তাব তুলতে দেন। এরপর বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।
আহসানুল ইসলাম সংশোধনী প্রস্তাব তোলার পর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এ বিষয়ে রুলিং দেন। সংসদের কার্যপ্রণালিবিধির সংশ্লিষ্ট বিধি উল্লেখ করে স্পিকার বলেন, মূল সংশোধনীতে বিলের ১০ দফায় সংধোশনীর প্রস্তাব ছিল। আর আহসানুল ইসলাম যে সংশোধনী প্রস্তাব এনেছেন, সেটিও এ দফার একটি উপদফা। এখানে বিলে কোন নতুন ধারা যুক্ত করা হয়নি। বা এমন কোনো নতুন দফাও যুক্ত করা হয়নি। এটি অপ্রাসঙ্গিক নয়।
স্পিকারের বক্তব্যের পর বিরোধী দলের সদস্য ফখরুল ইমাম কথা বলতে চাইলে স্পিকার মাইক না দিয়ে বলেন, ‘মাননীয় সংসদ সদস্য এটা আমার রুলিং। এ বিষয়ে আর আপনার কিছু বলার নেই।’ ফখরুল ইমাম এ সময়ে আবারও হাত তুললে জবাবে স্পিকার বলেন, আপনাকে সুযোগ দেওয়ার কোন বিধান নেই। আমি দিয়েছি আমার ব্যাখ্যা।
স্পিকারের রুলিংয়ের পর অর্থমন্ত্রীকে ফ্লোর দেন। এ সময় মাইক ছাড়াই বিরোধীদলের সদস্যরা চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন। পরে স্পিকার অর্থমন্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বিরোধীদলের সদস্যদের বলেন, ‘আমরা বিধির বাইরে কিছু করবো না।’
এটি বলার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধীদলের সংসদ সদস্যরা হইচই শুরু করেন। মাইক ছাড়াই কথা বলতে থাকেন মুজিবুল হক চুন্নু। তার পাশাপাশি কাজী ফিরোজ রশীদও দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করেন। একপর্যায়ে ফিরোজ রশীদকে মাইক দেওয়া হয়। তিনি অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমরা যে আজীবনের কথা বললাম, আপনি কী সেটা গ্রহণ করলেন? একজন পরিচালক আমৃত্যু থাকবে। সেটা গ্রহণ করছেন? না ১২ বছর করছেন? কোনটা সেটা আমাদের স্পষ্ট বলতে হবে।’
মুজিবুল হকও একই ধরনের বক্তব্য দেন। এ সময় বিরোধী দলের সদস্যরা হইচই করতে থাকেন। কিছু সময়ের জন্য সংসদে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। পরে স্পিকার অর্থমন্ত্রীকে আবারও মাইক দেন। তবে তিনি কথা বলেননি। এ পর্যায়ে স্পিকার সংশোধনী ভোটে দেন। দফাভিত্তিক সব সংশোধনী ভোটে দেওয়া হয়। অর্থমন্ত্রী আহসানুল ইসলামের সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এ সময় জাতীয় পার্টি ওয়াকআউট করে সংসদকক্ষ থেকে বেরিয়ে যান।
পরে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ব্যাংকের পরিচালকদের মেয়াদ ৯ বছর থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করার সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করার প্রতিবাদে আমরা ওয়াকআউট করেছি। বিল উত্থাপনের সময় ছিলো না- এমন সংশোধনী প্রস্তাব নজিরবিহীনভাবে গ্রহণ করা হয়েছে।