টাইটান নামের একটি সাবমেরিনে চড়ে আটলান্টিকের তলদেশে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে দেখতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন পাঁচ পর্যটক। এ ঘটনায় সর্বত্র শোকের ছায়া নেমেছে। পাশাপাশি টাইটানিক ট্যুরিজমের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কার্যকলাপে অংশ নেওয়া মানুষের ক্ষতির দায় ও ব্যবসার দায়বদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। খবর এনবিসি নিউজের।
পাঁচ আরোহীকে নিয়ে গত রোববার নিখোঁজ হয় ডুবোজাহাজ টাইটান। এরপর গত বৃহস্পতিবার তাদের সম্ভাব্য মৃত্যুর কথা জানানো হয়। টাইটান সাবমেরিনে পাঁচ যাত্রীর মধ্যে ছিলেন পাকিস্তানের একটি ধনী পরিবারের সদস্য শাহজাদা দাউদ (৪৮) ও তার ছেলে সুলেমান দাউদ (১৯), ব্রিটিশ অভিযাত্রী হ্যামিশ হার্ডিং (৫৮), ফরাসি নৌবাহিনীর সাবেক ডুবুরি পল অঁরি নাজোলে (৭৭) এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাবমেরিন সরবরাহকারী কোম্পানি ওশানগেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টকটন রাশ (৬১)। তিনি সাবমেরিন টাইটান চালাচ্ছিলেন।
টাইটানের দুর্ঘটনার পর আইনবিশেষজ্ঞরা একটি প্রশ্ন সামনে এনেছেন। যদি এ ধরনের কোনো বিপজ্জনক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে যাত্রীদের কোনো ক্ষতি হয়ে যায় কিংবা কেউ মারা যান, তবে এর আইনি কার্যকলাপ কী হবে? এ ঘটনায় কাকে দায়ী করা হবে? স্কাইডাইভিং, স্নরকেলিং বা স্কিইংয়ের মতো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একধরনের দায়মুক্তির ফর্মে স্বাক্ষর করতে হয়। এর মাধ্যমে অভিযান পরিচালনাকারী কোম্পানি দুর্ঘটনার দায় থেকে নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করে থাকে। তবে বিষয়গুলো আইনিভাবে বেশ অস্পষ্ট।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে কি না, এমন কোনো সুনির্দিষ্ট বিধি দেখা যায় না। দেখা যায়, ‘দাবিত্যাগ’ ফর্মে স্বাক্ষর থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই দায় বিমা কিনে রাখে। কারণ, দুর্ঘটনা ঘটলে গ্রাহকদের স্বাক্ষর করা দাবিত্যাগ ফর্ম শেষ পর্যন্ত কাজ না–ও করতে পারে।
এ বিষয়ে কিছুটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক কেনেথ এস আব্রাহাম। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কোনো বিপর্যয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দায়বদ্ধ কি না, তা নির্ভর করে যে রাজ্যে ব্যবসাটি পরিচালিত হয়, সেখানকার নিজস্ব আইনের ওপর। এমনকি দাবিত্যাগ ফর্মের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারকের ব্যাখ্যার ওপরেও তা খানিকটা নির্ভর করে।
অন্য ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানের মতো ওশানগেটের ক্ষেত্রেও অভিযাত্রীদের একটি দায়মুক্তি কাগজে স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছিল। মাইক রেইস নামের ওশানগেটের একজন সাবেক যাত্রী জানান, তিনি যখন ওই দাবিত্যাগ ফর্মে স্বাক্ষর করেছিলেন, তখন এটি বারবার মৃত্যুর সম্ভাবনার ওপর জোর দিয়েছিল।
রেইস তার যাত্রার সময়ের অভিজ্ঞতাটি বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে ডুবোজাহাজে চড়ার কষ্টকর কাজটি থেকে শুরু করে এর ভেতরে নিজের অভিজ্ঞতা পর্যন্ত সব কথা বলেছেন তিনি। রেইস জানান, ডুবোজাহাজটি পানির নিচে থাকার সময় সমস্যা দেখা দেয় এবং এরপর সেটিকে মেরামতের জন্য পানিপৃষ্ঠে আবার ফিরিয়ে আনা হয়।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক নোরা ফ্রিম্যান ইংস্ট্রোম বলেন, এভাবে একটি দাবিত্যাগ ফর্ম দিয়ে কোনো অন্যায় মৃত্যুর জন্য ব্যবসায়িক কোম্পানিকে দায়মুক্তি বা অব্যাহতি দেওয়া যায় না। যদি কোনো কোম্পানি বেপরোয়া আচরণ করে, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আদালত তাকে দায়মুক্তি দেবেন না।
ফ্রিম্যান ইংস্ট্রোম আরও বলেন, এসব কর্মকাণ্ডে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ঠিক কতখানি, তা দাবিত্যাগ ফর্মে স্পষ্ট করে দেওয়া উচিত। অর্থাৎ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাবিত্যাগ ফর্মে গ্রাহকের এই সম্মতি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে রেহাই দিতে পারে না। তবে দেখা গেছে, এ ধরনের যেসব মামলা বিচারের পর্যায়ে গেছে, তার অধিকাংশ শেষ পর্যন্ত সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে।
এর অবশ্য কারণও রয়েছে। অধ্যাপক কেনেথ এস আব্রাহাম বলেন, প্রতিবছর স্কাইডাইভিং, স্কুবা, প্যারাসেইলিং ও অন্যান্য অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা করা হয়। এসব মামলার নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, কিছু মামলা বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে সাধারণভাবে মামলাগুলো যদি কেউ চালিয়ে নিতে চান, সে ক্ষেত্রে কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে।